একটি ফটো: আমাদের প্রত্নতত্ত্ব-ইতিহাসের যাত্রা, এবং গন্তব্য

মহাস্থানে জনপ্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা পরিচালনার সময়ে একটি ছবি তুলেছেন শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম। তিনি ছবিটি তার ফেবু টাইমলাইনে পোস্টও করেছেন। অটোরিকশার পেছনে লেখার ছবি। উপরে লেখা মহাস্থান মাজার, আর নিচে জাদুঘর টু বাসরঘর।

মহাস্থানের একটি অটো/ইজিবাইক ও পশ্চাৎপটের লিখন। ফটো: জাহিদুল ইসলাম।

বেশিরভাগ মানুষের কাছেই এই অটোর পশ্চাদপটের লেখার তেমন কোনো আলাদা ব্যঞ্জনা নেই। যারা মহাস্থান ও এখানকার ইতিহাস, আর প্রত্নতত্ত্ব সম্পর্কে ধারণা রাখেন, সেসব মানুষজনের কাছে এই নামগুলো অপরিচিত হওয়ার কথা না।মহাস্থান মাজার মহাস্থানগড়ের প্রাচীরের উপরে অবস্থিত হযরত সুলতান বলখী (রহঃ)-এর মাজার।উনি মাহীসওয়ার নামেও সমধিক পরিচিত।স্থানীয় মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত ও জনপ্রিয় কথ্য ইতিহাস অনুযায়ী, তিনি তৎকালীন মহাস্থানের হিন্দু রাজা পরশুরামকে অলৌকিক শক্তিবলে পরাজিত করেছিলেন।

অন্যদিকে, মূলধারার ইতিহাসে ও প্রত্নতত্ত্বে মহাস্থানগড়কে দক্ষিণ এশিয়ার পূর্ব প্রান্তের অন্যতম একটি নগরকেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। যার নাম ছিল পুন্ড্রনগর বা পুন্ড্রবর্ধনপুর। প্রাচীর বেষ্ঠীত এই নগরকেন্দ্রের চারপাশে বিশাল এলাকাব্যাপী ছড়িয়ে আছে আরো অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। এসব প্রত্নস্থানের মধ্যে বেশ কিছু প্রত্নস্থানে ঔপনিবেশিক সময় থেকে এখন পর্যন্ত খনন ও প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। এসব প্রত্নস্থানের মধ্যে একটি বিখ্যাত স্থান হলো গোকুল গ্রামের গোকুল মেড়/মেধ। এই গোকুল মেড়ে খনন পরিচালনা করে একটি বৌদ্ধ স্তূপ-মন্দির ও পরবর্তীকালীন একটি হিন্দু মন্দির খুঁজে পাওয়া গেছে। এই মন্দিরগুলোর নিমাণশৈলীর লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, একটি উপরে একটি আবদ্ধ প্রকোষ্ঠ নির্মাণ করে উঁচু একটি পরিসর তৈরি করে তার উপরে মন্দিরগুলো নির্মিত। এধরনের স্থাপত্যনির্মাণশৈলী প্রকোষ্ঠবিশিষ্ট/সেলুলার স্থাপনা রীতি হিসেবে সমধিক পরিচিত। উল্লেখ্য, গোকুল মেড় স্থানীয় কথ্য ইতিহাসে বেহুলা (-লক্ষ্মীন্দরের) বাসরঘর হিসেবে খ্যাত। ফটোতে জাদুঘর বলতে সরকারী প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর পরিচালিত সাইট মিউজিয়ামকে বোঝানো হয়েছে। মহাস্থানের পরিচিত স্থান-নাম হিসেবে- ফটো দেখে বোঝাই যায়- মহাস্থান মাজার, জাদুঘর ও বাসরঘর স্থানীয় মানুষজন ও মাজারে আসা ভক্তবৃন্দ, ভ্রমণকারী, পিকনিক করতে আসা মানুষজনের কাছে পরিচিত, জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য।

গোকুল মেড় বা বেহুলার বাসরঘরের কাহিনি নিয়ে লিখিত বইয়ের প্রচ্ছদ। মহাস্থানে এমন বই বিভিন্ন দোকানে বিক্রি হয়।

একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ ও সমাজবিজ্ঞানের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে এই ফটোটি আমার কাছে কেন বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হলো? ফটোটি প্রথমে দেখার অভিব্যক্তি হতে পারে কৌতুকের বা ঠাট্টার। জাদুঘর থেকেও বাসরঘরের একটি ভিন্ন যৌন সুড়সুড়িময় ঠাট্টাও এখানে ব্যক্ত হতে পারে। বিশেষকরে, বাসরঘর নিয়ে জনপরিসরে প্রচলিত বিবিধ ঠাট্টা, ইয়ার্কি ও আচারের কথা মাথায় রাখলে। জাদুঘর থেকে বাসরঘরে যাত্রা, কিংবা প্রত্যাবর্তনকে মহাস্থানের জনপরিসরে প্রচলিত ও প্রবল চিন্তার ও চর্চার পরিপ্রেক্ষিতে রেখে বিশ্লেষণ করলে তাৎপর্য বা দ্যোতনা স্পষ্ট হতে পারে।

রাজা পরশুরাম ও সুলতান মাহীসওয়ারর মধ্যের দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধের কাহিনি নিয়ে লিখিত বইয়ের প্রচ্ছদপট। লেখক তবিবুর রহমান মহাস্থানের কথ্য কাহিনিগুলোকে লেখ্য রূপ দেয়ার পথিকৃত। উনি ইন্তেকাল করেছেন। তার পুত্র এখন সত্ত্বাধিকারী। মহাস্থানবাজারে একটি দোকানে এই বইগুলো বিক্রিহয়।

প্রত্নতত্ত্ব চর্চা, ইতিহাসবোধ বা ইতিহাসচেতনা, বিদ্যায়তনে বিশেষজ্ঞদের তৈরি করা ও প্রচার করা জ্ঞানের নিরিখে বাসরঘর শব্দটি বা ধারণাটির কোনো আলাদা ব্যঞ্জনা এখানে নাই। সুলতান মাহীসওয়ারের ঐতিহাসিকতা নিয়েও অনেক তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। তিনি কবে এসেছিলেন, পরশুরাম নামে কোনো রাজা আদৌ এই নগরে বা অঞ্চলে ছিলেন কী-না, পরশুরামের সঙ্গে আদৌ কোনো যুদ্ধ হয়েছিল কী-না -তা নিয়ে ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। গোকুলমেড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন করে উন্মোচিত মন্দিরগুলো যে বেহুলা-লক্ষ্মীন্দরের বাসরঘর নয় সেটা প্রচলিত অফিসিয়াল ও বিদ্যায়তনিক আলোচনায় স্পষ্ট। অন্যদিকে, জাদুঘর একদমই আধুনিক একটি পরিসর। বিভিন্ন নিদর্শন সংগ্রহ করে, বিশেষ পরিকল্পিতভাবে মানুষকে দেখানো ও শেখানোর উদ্দেশ্য থেকেই আধুনিক সময়ে জাদুঘর নামক পরিসরটি তৈরি হয়েছে। মানুষকে নিজের ঐতিহ্য ও হেরিটেজের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়াটা প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরগুলোর ঘোষিত উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে একটি।

বাসরঘর, এইখানে, আধুনিক প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাস দ্বারা স্বীকৃত কোনো পরিসর ও গন্তব্য নয়। অন্যদিকে, জাদুঘর স্বীকৃত, অনিবার্য ও প্রতিষ্ঠিত একটি গন্তব্য। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্টভাবে শিক্ষিত, সচেতন ও আত্মপরিচয় গঠনের জন্য এই গন্তব্যে গমন অতিআবশ্যকীয় ও স্বাভাবিক বলেও আমরা দাবি করি। বাসরঘরে যাওয়া নিয়ে জনপরিসরে নানাবিধ ঠাট্টা ও কৌতুক প্রচলিত থাকলেও, প্রচলিত, প্রবল বিশেষজ্ঞজন কর্তৃক লিখিত, প্রচারিত ও পঠিত ইতিহাসে এই বাসরঘরের কোনো স্বীকৃতি তো নাইই। বরং মানুষজনের গোকুল মেড়কে ‘বাসরঘর’ হিসেবে চিহ্নিত করা, গ্রহণ করা ও একটি ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযাত্রার গন্তব্য হিসেবে বিবেচনা করাকে কুসংস্কার, বা সঠিত ইতিহাসবোধের অভাব হিসেবেই ঠাহর করা হয়; হেয় করা হয়।

আমার আগ্রহ তাহলে জনপরিসরের ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযাত্রার স্বীকৃত গন্তব্য আর বিদ্যায়তনিক পরিসরের স্বীকৃত গন্তব্যেও মধ্যকার স্পষ্ট বিরোধ ও বৈপরিত্য প্রসঙ্গে। কথ্য ইতিহাস, বা কথ্য ইতিহাসের লিখিত বই, যেগুলো মহাস্থান বাজারসহ বিভিন্ন দোকানে বিপুল সংখ্যায় বিক্রি হয়, আর বিদ্যায়তনিক পরিসরে গ্রহণযোগ্য, তথ্য-প্রমাণ নির্ভর, বস্তুনিষ্ঠ-নিরপেক্ষ-নৈর্ব্যক্তিক হিসেবে ঘোষিত প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাসের মধ্যকার বৈপরীত্য ও বিরোধ (ও সংযোগ) নিয়ে আলোচনা করা কি জরুরি?

মহাস্থানে প্রতিদিন আসা শত শত মানুষ এই কথ্য ইতিহাসের ভোক্তা, এই অলৌকিক কাহিনী নির্ভর পৌরাণিক/কিংবদন্তী হিসেবে পেশকৃত ইতিহাসের প্রতি আস্থাশীল। মহাস্থানের স্থানীয় মানুষজনের দৈনন্দিন জীবন-যাপনের সঙ্গে লেপ্টে আছে সুলতান মাহীসওয়ার ও পড়শুরামের কাহিনি, বেহুলা-লক্ষ্মীন্দরের কাহিনিসহ আরো অসংখ্য কাহিনি, যেগুলোকে আমরা প-িতগণ নাকচ করে দেই অতিকথন/মিথ ঠাহর করে। আবার আমরাই সেক্যুলার, যৌক্তিক ও নৈব্যক্তিক প্রত্নতাত্ত্বিক আলামত নির্ভর ইতিহাসের আখ্যানে অতিকথনের আশ্রয় নেই। অতিকথন বা পৌরাণিক কাহিনিকে তথ্য-প্রমাণ-যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করতে কোটি কোটি টাকার লগ্নি করি।

মহাস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে ‘জাদুঘর’ আর ‘বাসরঘর’ ‍দুটো ভীষণ বৈপরীত্যজ্ঞাপক শব্দ/প্রত্যয়। আবার, এরা পরস্পর পরস্পরের পরিপূরকও বটে। এই যাত্রায় প্রস্থানবিন্দু আর গন্তব্য। আধুনিক-যৌক্তিক-একরৈখিক ইতিহাসবোধের, স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে ধরে-নেয়া প্রত্নতত্ত্বের আখ্যানের সঙ্গে জনপরিসরে প্রচলিত, স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে অনুমিত, অথচ বহুরূপী, নমনীয় আখ্যানের ইতিহাস-প্রত্নতত্ত্বর (যাকে আমরা মিথিকাল/পৌরাণিক/অসত্য বলে বিবেচনা করি, কিংবা বিজ্ঞানের ও যুক্তির, স্বীকৃত ও প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতির ছাঁচে ফেলে নিরিখ করতে চাই, বা নিদেনপক্ষে সমাজের ভারসাম্য রক্ষায় ক্রিয়াগত মূল্য বিবেচনার মানদণ্ড হিসেবে সীমাবদ্ধ করে ফেলি) বিপরীত ও আপতদৃষ্টিতে সংযুক্ত হওয়ার অযোগ্য দুটি গন্তব্যকে জনপরিসরে কী-ভাবে এই যাত্রায় সংযুক্ত করে ফেলা হয়েছে সেটা আমাদের নজর ও মনযোগ দাবি করে।

জনপরিসরের ইতিহাসবোধ ভুল না ঠিক সেটা নির্ধারণ করার আগে আমাদের, মানে বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত শিক্ষিত ও গবেষক মানুষজনের কাছে স্পষ্ঠ হওয়া দরকার, কোন ইতিহাস বা প্রত্নতত্ত্বের কথা তারা বলছেন। তাদের ইপ্সিত ইতিহাসের ভোক্তা কারা? জনপরিসরের অতীতচেতনা ও ইতিহাসবোধে একটি পরিসরকে অতীতের নানামুখী বিচিত্র বয়ানের মাধ্যমে চিহ্নিত করার প্রবণতার এই ধরনগুলো প্রবল হয়ে থাকে কেন? এই বয়ানগুলো কেবলই কী অলৌকিকের প্রতি জনপরিসরের আকর্ষণ ও আস্থাকেই প্রকাশ করে? এগুলো কি কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস, শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব?

জনপরিসরের প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাস যাত্রার যানবাহন, রাস্তা ও গন্তব্য নিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে সহযাত্রী না হলে ইতিহাসের পরস্পরবিরোধী, সম্পুরক ও স্থিতিস্থাপক আখ্যাননির্মাণের কৃৎকৌশলের সঙ্গে আমাদের বোঝাপড়া কীভাবে সম্ভব? এই বোঝাপড়ার মাধ্যমে ইতিহাসের সঙ্গে বৃহত্তর জনগণের যুক্ততা (বা বিযুক্ততা) বিবিধ ধরনগুলোর আমলে নেওয়া কি সম্ভব? একটি স্থান কীভাবে জনমানুষের সঙ্গে নানামুখী সম্পর্ক, বোঝাপড়া, সংযোগ ও বিযুক্ততার মধ্য দিয়ে একটি পরিসরে পরিবর্তিত হয় যে-পরিসর ওই মানুষগুলোর জীবনযাপন ও পরিচয়ের জন্য অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে? যে-পরিসরের পরিচয়ও এই সম্পর্কের মাধ্যমে নির্মিত, নির্ধারিত ও পরিবর্তিত হয়? জনমানুষের অস্তিত্ব, যাপন, পারস্পরিক সম্পর্ক, ভালোবাসা, সংহতি, ঘৃনা, আক্রোশ, পেশা, জীবিকা কীভাবে একটি পরিসর ও তার বিবিধ অতীতের আখ্যানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যু্ক্ত?

মহাস্থানের মহান স্থানগুলোর মাহাত্ম্য এখানেই। আমাদের স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নেয়া প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক যাত্রা ও যাত্রার গন্তব্য নিয়ে সংশয় তৈরি হওয়ার স্থান এই মহাস্থান। প্রচলিত ঐতিহ্য ও হেরিটেজ সচেতনতা তৈরির নানাবিধ কর্মকান্ডের ও তৎপরতার যাত্রা ও গন্তব্য যে ভুল তাও প্রমাণ করে মহাস্থানের এই বাহন, ও বাহনের পৃষ্ঠপটে অঙ্কিত/লিখিত যাত্রা ও গন্তব্যের বয়ান।

যাত্রা আর গন্তব্য নিয়ে এই প্রশ্ন ও সংশয় আমার সার্বক্ষণিক।

কৃতজ্ঞতা : জাহিদ, রবিউল, কাব্য ও সানি।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

Blog at WordPress.com.

Up ↑

%d bloggers like this: