সত্তাশ্রয়ী সম্পর্ক, সম্পর্কআশ্রিত সত্তা

কিংবা, দ্যাখো, ইতস্তত অসুস্থ বৃক্ষেরা

পৃথিবীর পল-বিত ব্যাপ্ত বনস্থলী

দীর্ঘ-দীর্ঘ ক্লান্তশ্বাসে আলোড়িত করে;

তবু সব বৃক্ষ আর পুষ্পকুঞ্জ যে যার ভূমিতে দূরে-দূরে

চিরকাল থেকে ভাবে মিলনের শ্বাসরোধী কথা

[বিনয় মজুমদার, ফিরে এসো চাকা]

আমি, আমরা তখন ওয়াজেদকে কাঁধে নিয়ে ঘুবে বেড়াতাম। খনন করার সময় ও আমাদের কাছে বারবার চলে আসতে চাইত। ওর বয়স তখন ছয় মাস। এখন সম্ভবত বার। শেষবার দেখেছি ২০১৩ সালে। ঘোড়াঘাটে খনন করার সময়। মাজেদা ফুফুর ছেলে সারাক্ষণ আমাদের সঙ্গে থাকত। ওর বয়স তখন ৮/৯। পরে মাদ্রসায় ভর্তি হয়েছিল। কয়েকদিন আগে বিয়ে করেছে। বিরামপুর বাজারে এখন লোহার গ্রিল বানানোর কাজ করে। ছোট ভাই সোহেল রানাও সঙ্গে থাকে। মাজেদা ফুফু জানালেন ওদের সবচেয়ে ছোট ভাইয়ের নাম রাখা হয়েছে জাহিদ হাসান। মাসুদ রানা, সোহেল রানা, জাহিদ হাসান – তিন সেলিব্রেটির নামে নাম। একজন ফিকশনাল আর দুইজন বাস্তবের। নাকি, এই সেলিব্রেটিজম বাস্তব ও অবাস্তবের সীমা অতিক্রম করে যায়, অথবা গেছে।

বৃষ্টি নামলে রমণী কিসকু আর আমিনা কিসকু দিদিদের বাসার দাওয়ায় পাটি পেতে বসে থাকতাম। কখনো তাদের কাছ থেকে কাঁথা নিয়ে পাটির উপরে ঘুমিয়েও পড়েছি অনেকবার। শাক দিয়ে ভাত খেতে দেখতাম। ভাত পচিয়ে চোয়ানি বানানো দেখতাম। ওই রকম গরিবী হালে ভাত খেতে দেখেও আমাদের হিংসা হত। আমরা মুড়ি-চানাচুর আর টিপ বিস্কুট দিয়ে দুপুরের খাবার খাই তখন।

ওয়াজেদের দাদিকে আমরাও দাদি ডাকতাম। উনি ঝিরিঝিরি করে মুচমুচা করে অসাধারণ আলুভাজি করতেন। আমরা অনেক অনুরোধ করলে আলুভাজা আর আলুর ডাল দিয়ে মোটা ইরি চাল দিয়া ভাত খাইতে দিতেন। ভীষণ গরিব। অনুরোধ করতেও সঙ্কোচ বোধ করতাম।

মাসুম তখন ১৫/১৬ বছরের। ঘুড়ে বেড়ায়। বাড়ীর লাগোয়া ছোট, ভাঙ্গা, আধো-আলো-আধো-অন্ধকার একটি ঘরে বিভিন্ন মনোহরী কম দামী জিনিস নিয়ে একটা দোকানেও বসে কখনো কখনো। ওই বয়সেই বর্ডার এলাকার বিভিন্ন বৈধ-অবৈধ ব্যবসা সম্পর্কে ওর অগাধ জ্ঞান।

জম্বুলেশ্বর মণ্ডবের মেলা। পেছনে প্রত্নতাত্ত্বিক ঢিবির উপরে ঔপনিবেশিক সময়ে স্থানীয় পৃষ্ঠপোষকের টাকায় বানানো ভগ্নপ্রায় শিবমন্দির। শিব এখানে জম্বুলেশ্বর নামেই পরিচিত।

মীর্জাপুরে যেখানে খনন করতাম সেটা একটা বড় মাঠের মধ্যে। বর্ডার থেকে ৭/৮ মাইল দুরে। দিনাজপুর যাওয়ার আগে বর্ডার বলতে আমার যে ধারণা ছিল তা কতটা উদ্ভট সেটা আমি টের পাওয়া শুরু করি দিনাজপুরে কাজ শুরু করার পরে। ছোট বেলা থেকে ম্যাপ দেখে, পত্রিকা পড়ে বা অন্যান্য জায়গা থেকে যেভাবে বর্ডার চিনেছি সেই চেনাজানা খুবই ভুল। বর্ডার এলাকার মানুষদের দেখে আর চিনে বুঝতে পারলাম মানচিত্রের বর্ডার আর মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত বর্ডার সম্পূর্ণ আলাদা, ভিন্ন। বর্ডার এমন একটি পরিসর যেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক অন্যান্য পরিসর থেকে ভিন্ন। এখানে মানুষের নৈমিত্তিক জীবনে বর্ডার সতত উপস্থিত। স্মৃতিতে, সত্তায়, বর্তমানে। পারস্পরিক সম্পর্কে। বোঝাপড়ায়। স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক, বৈধতা ও অবৈধতার সংজ্ঞা এখানে আলাদারকম। আমাদের দেখা বর্ডার নিয়ে, বর্ডারের পরসরে ও শর্তে মানুষের সম্পর্ক নিয়ে অন্য কোনো সময় লিখব।

বিরামপুরের মির্জাপুরে তিনটা সাঁওতাল পাড়া। তারই একটার পাশে বিরাট মাঠের মধ্যে ছোট একটা ঢিবিতে আমরা খনন করি। মাঠ পেরোলেই ছোট যমুনা নদী। ওই পাড়ায় তখন মাত্র তিন ঘর বাঙালি, মুসলমান। ২০০৬ সালে আমাদের স্বনির্ভর, নিজেদের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক খনন। থাকি বিরামপুর শহরে। ভাড়া ঘরে। রোজ আসি ভ্যান বা রিক্সায় চড়ে। দুপুরে সাধারণত মুড়ি-চানাচুড়, টিপ বিস্কুট খাই আমরা। সঙ্গে ব্লাক কফি। স্টিলের ছোট গ্লাসে।

জম্বুলেশ্বর মন্দিরের চৈত্র সংক্রান্তির মেলায় বিক্রির জন্য রাখা বিভিন্ন পোস্টার।

মাজেদা নামের এক নারীকে আমরা ফুফু ডাকা শুরু করি। কেন ফুফু,- আপা, খালা বা অন্য কোনো সম্বোধনে কেন নয় তা ঠিক মনে নাই। উনার স্বামী কাঠমিস্ত্রীর কাজ করেন। উনি আমাদের আগলে রাখেন। সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। সাঁওতাল অধ্যুষিত পাড়ায় উনারা সংখ্যালঘু। সংখ্যাগুরুদের সম্পর্কে উনার মুখ থেকে কোনোদিনও (প্রায় দুই মাস আমরা ছিলাম ওইখানে) কোনো বাজে কথা আমি শুনি নাই। পাশেই রমণী দিদিদের সঙ্গে উনাদের সম্পর্ক ভীষণ ঘনিষ্ট। যদিও খাদ্যাভাস, রীতিরেওয়াজ পরস্পরের আলাদা। কাছেই জম্বলেশ্বর মণ্ডবে মন্দিরে চৈত্রসংক্রান্তির সময় মেলা হয়। বড় মেলা। চৈত্রসংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে মাজেদা ফুফুকে আমরা কম দামের সুতির কাপড় কিনে দিলে উনি বাসায় আমাদের সবার জন্য ফতুয়া বানিয়ে দেন। বাসায় বসে উনি সেলাই করতেন। টাকা আয় হতো তাতে। ওদিকে জম্বুলেশ্বর ম-ব একটি বড় প্রতœতাত্ত্বিক ঢিবি। তার উপরে ঊনবিংশ শতকে নির্মিত একটি শিব মন্দির। ওই মন্দিরকে কেন্দ্র করেই পূজা ও মেলা। ইদানিং নিরাপত্তার ওজুহাতে মেলার ব্যপ্তী ও সময়সীমা কমিয়ে দেয়া হয়েছে। ২০১৩ সালেও আমরা ওই মেলায় যাই। মীর্জাপুরে যাই। সবার সঙ্গে দেখা করতে।

সরলা রানী হাজদা, আমাদের সবার সরলাদি, খননদলের সবার খুব খেয়াল রাখতেন। আমরা খনন করার সময় উনি বান্ধবীদের নিয়ে বসে থাকতেন। স্থানীয় সাওতালদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়। দারুণ সংগঠক। সিধু-কানু দিবসের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ঢাকা চলে আসতেন। উনাদের মাটির ঘরে আমরা বসে থাকতাম। বেসরকারী সংস্থার বিভিন্ন প্রজেক্টের কর্মকা-ের সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রে সাঁওতালদের মধ্যে শ্রেণীবিন্যাস যথেষ্ট স্পষ্ট। সবাই যে এসব কর্মকা-ের ফলে লাভবান হচ্ছেন সেটা আমার মনে হয় নাই। আমার আরেকটি পর্যবেক্ষণ হলো, বিভিন্ন চার্চের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা-না-থাকার পরিপ্রেক্ষিতে প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধার হেরফের হয়। চ-ীপুর, ধানঝুরি-কালিশহর, মীর্জাপুর, বেলওয়া, দোমাইল, চকজুনিদ সহ বিভিন্ন জায়গার সাঁওতালদের মধ্যে চার্চ ও বেসরকারী সংগঠনের তৎপরতার কারণে যেমন সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে তেমনই এক গভীর বৈষম্যও সৃষ্টি হচ্ছে। মীর্জাপুরে আমরা দেখেছি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ধানকাটার শ্রমিক হিসাবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষদের পরিভ্রমণ করতে। ভূমিহীন সাঁওতালরা ধানকাটার মৌসুমে তুলনামূলকভাবে সস্তা শ্রম সরবরাহকারী একটি সমষ্টিতে রূপান্তরিত হন।

বোচাগঞ্জের সতিমান ঠাকুরের মন্দির ও মেলা। একটি বুদ্ধ প্রতীমা এখানে সতীমান ঠাকুর নামে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজনের কাছে পুজিত হন।

প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ ও খনন মানেই মাটি খোড়াখুড়ি। পরিশ্রম। কিছু নিদর্শন আবিস্কার। নথিভুক্তকরণ। গবেষণাগারে কাজ। প্রতিবেদন প্রস্তুত করা। সেটা গবেষণা প্রবন্ধ আকারে ছাপানোর জন্য তৈরি করা। বস্তুনিষ্ঠ, নৈব্যক্তিক ও উপাত্তনির্ভর। মর্টিমার হুইলারের মতন প্রত্নতাত্ত্বিক মাঠকর্মকে ভিত্তিপ্রদানকারী পণ্ডিতগণ সামরিক বাহিনীর নিয়মনিষ্ঠা ও শৃঙ্খলার মত করে পরিচালনা করার কথা বলেছেন। এমনটাই মনে করা হয়ে থাকে এখনও। গোপন থেকে যায় মাঠে কাজ করার সময় সম্পর্কিত হওয়ার আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ ও তুচ্ছ কাহিনিগুলো। আকষ্মিক, হঠাৎ, ক্ষণস্থায়ী মোলাকাত। কাকতালীয় দেখা হওয়া। সম্পর্কের ও সত্তার সমাপতন। প্রত্নতত্ত্ববিদদের এবং জনমানুষের। কাজ শুরুর সময় থেকে শেষ করা পর্যন্ত মানবীয় ও না-মানবীয় বিবিধ সংশ্লেষ। বিপত্তি। বিতণ্ডা, অবিশ্বাস। ভালোবাসা। ধৈর্য্য । ভুল। অনুশোচনা। ঘনিষ্ঠতা। আস্থা। মায়া। সর্বোপরি, মুখাবয়ববিহিন, নামহীন মানুষের স্মৃতি আর প্রত্নতত্ত্ববিদদের সত্তার ঘনিষ্ঠ বোঝাপড়া।

সতীমান ঠাকুরের মেলার আরেকটি দৃশ্য।

মানুষ হিসাবে আমাদের সত্তা ও পরিচয় গঠিত হয়, আকার পায় সম্পর্কের মধ্য দিয়ে। আমি কেবল ঘনিষ্ঠ সংলগ্নতার দিক ইঙ্গিত করছি না। বিদ্বেষ, ঘৃণা, অবজ্ঞা কিংবা নির্লিপ্তির কথাও বলছি। লিপ্তি আর নির্লিপ্তির সমীকরণে যে মানবসত্তা গঠিত হতে থাকে আমৃত্যু তাতে মানুষের পাশাপাশি না-মানুষী দুনিয়ার (অন্যান্য জীব, দৈনন্দিনতায় সম্পর্কিত বস্তুরাজিসহ) সকলেরই কোনো-না-কোনো মাত্রায় ও প্রকারে ভূমিকা থাকে। একভাবে, আমাদের ‘নিজসত্তাকে’ আসলে ‘অপরসত্তাসমূহের’ সঙ্গে সম্পর্কের একটি অভিব্যক্তি হিসেবে ঠাহর করা যায়। সত্তার এই গঠন অনেকক্ষেত্রেই স্বয়ংশাসিত ও সচেতন না। সম্পর্কের বিভিন্ন শর্ত সত্তার এই গঠন, পুর্নগঠন ও রূপান্তরে ভূমিকা রাখে। সত্তা ও সম্পর্কের সীমানা নির্ধারণ ও সীমানার নিরন্তর বদল ঘটতে থাকে। মানুষের অনুভূতি, অপরাধবোধ, অপরাধপ্রবণতা, সহিংসতা, উপলব্ধি, আবেগ ও সংবেদনশীলতা সম্পর্কের আবর্তে ঘুরপাক খায়, গঠিত হয়, পরিবর্তিত হয়। সম্পর্কের ভিতর দিয়ে ও সম্পর্কের মাধ্যমে গঠিত মানব সত্তার সক্রিয়তা তাই বলে যে, বাধা-ধরা নিয়ম মেনে চলে তা কিন্তু না। সমাজবিজ্ঞান ও মনোসমীক্ষণ নিয়ে যারা কাজ করেন তারা বারবার এই অনির্দিষ্টতার দিকেও, আপতিকতার দিকেও আমাদের মনোযোগ ফেরানোর চেষ্টা করেছেন। যুক্তিবুদ্ধি ও কা-জ্ঞান দিয়ে মানবসত্তার এই গঠনকে বোঝা ও মোকাবেলা করতে যাওয়ার ব্যর্থতা ইতিহাসে অনেক আছে। এই লেখায় এই আলোচনার দিকে আমি যাব না। আগ্রহীগণ জুডিথ বাটলারের এই বক্তৃতাটি শুনে দেখতে পারেন, বা আশীষ নন্দীর ‘ঘনিষ্ট শত্রুতার’ ধারণাটি নিয়েও চিন্তা করতে পারেন।

সতীমান ঠাকুর নামে পুজিত বুদ্ধ প্রতীমা।

উপরের অনুচ্ছেদটি লেখার উদ্দেশ্য হলো আমাদের প্রত্নতাত্ত্বিক মাঠকর্মের সঙ্গে সম্পর্কের বিজড়ন ও সংশ্লেষ আর বিচ্ছেদ ও স্মৃতি নিয়ে আলাপ শুরু করা। আমরা কোথাও জরিপ বা খনন করতে যাওয়ার সময় প্রত্যেকেই একটি পূর্বগঠিত সত্তাকে বয়ে নিয়ে যাই। একদম প্রথম যিনি মাঠকর্মে যান বা যাচ্ছেন তার একটি নিজসত্তা তিনি ধারণ করেন, এবং কাজে যাওয়ার সময় সেই সত্তা আর তিনি অবিচ্ছেদ্য থাকেন। শ্রেণীগত, লিঙ্গীয়, জাতিগত, মতাদর্শীক, প্রশিক্ষণগত, বিদ্যায়তনিক, অর্থায়নকারী সংস্থার শর্তসাপেক্ষে সেই সত্তা গঠিত হয়, আর এই গঠন প্রক্রিয়া চলমান থাকে। মাঠে কাজ করার জন্য যাওয়ার আগে তার অনুভূতি, আবেগ, সংবেদনশীলতা, সংশয়, সন্দেহ, ভীতির ঘনিষ্ট সংশ্লেষ সত্তার সঙ্গে ঘটে যায়। তিনি উত্তেজিত থাকেন অ্যাডভেঞ্চারের আশায়। তিনি সংশয়ে থাকেন তার সক্ষমতা নিয়ে। তিনি আত্মবিশ্বাসী থাকেন তার সামর্থ নিয়ে। কিন্তু বেশিরভাগেই অনুভূতিমালায় ও আবেগের গড়নে মানুষ অনুপস্থিত থাকে।

চুনা পীরের ওরসের দিন। যে বৃক্ষর মধ্যে পীর সাহেব তাঁর অলৌকিক শক্তিবলে বিলীন হয়ে গিয়েছিলেন সেই বৃক্ষর সামনে চুন বিক্রি করছেন ভক্তবৃন্দ। কাছেই বিরামপুরের চণ্ডীপুর ও চরকাইয়ের বিভিন্ন প্রত্নস্থান। সন্নিকটে আসুরার বিল। এই বিল নিয়েও রয়েছে নানা গল্পকথা।

আমরা অনেকেই বার বার বলার চেষ্টা করি প্রত্নতাত্ত্বিক মাঠকর্ম আসলে জাতিতাত্ত্বিক গবেষণা, একটি লোকবিদ্যা। যদিও টেক্সটবুকগুলোতে সেটা আলোচিত হয় না। জাতিপ্রত্নতত্ত্ব নামে যে একটি শাস্ত্র্র প্রত্নতত্ত্বে আছে। জাতিতত্ত্বকে সেই শাস্ত্ররই এখতিয়ারভুক্ত ভাবা হয়। অথচ প্রত্নতাত্ত্বিক মাঠকর্ম নিরন্তর, অথচ অসমাপÍ সম্পর্কেরাজির মোকাবেলার মধ্যদিয়ে সংঘঠিত একটি কাজ ছাড়া আর কিছুই না। এই সম্পর্করাজিকে বোঝার জন্য আমরা কয়েকটি ভাগে ভাগ করতে পারি: যেমন: একটি দল যখন কোথাও প্রত্নতাত্ত্বিক মাঠকর্মের জন্য যায় তখন সেটা একটি সামষ্টিক কাজ হয়ে দাঁড়ায়। মানে হল, দলের বিভিন্ন সদস্যের মধ্যকার সম্পর্ক। আবার, স্থানীয় যে মানুষজন খননকারী হিসাবে কাজ করেন তাদের সঙ্গে সম্পর্ক; জরিপ করতে গেলে স্থানীয় মানুষজনার সঙ্গে নিত্যনৈমিত্তিক আর ক্ষণিকের সম্পর্ক। একটা ঘরে বা গেস্টহাউসে যখন কয়েকমাস থাকা হয় তখন প্রতিবেশী, বাজারের দোকানী, ইলেকট্রিশিয়ান, যানবাহনের ড্রাইভার, চায়ের দোকানদার ও দোকানে আসা খদ্দেরসহ মানুষজন ও তাদের সঙ্গে সম্পর্ক। যে-স্থানে খনন বা মাঠকর্ম পরিচালিত হচ্ছে সেই স্থানের পাশের গ্রামের/পাড়ার মানুষগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক। প্রতিদিন যে ভ্যানরিকশা বা ব্যাটারিচালিত অটোতে আমরা সাইটে যাই তার চালকের সঙ্গে সম্পর্ক। যিনি আমাদের সকালের রান্না করেন আর আমরা সাইটে বসে খাই তার বা তাদের সঙ্গে সম্পর্ক। প্রশাসনের আর পুলিশ প্রশাসনের বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে আমাদের প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখতে হয়। সম্পর্ক। প্রতিদিন অসংখ্য বিভিন্ন সত্তার মানুষ কাজ দেখতে আসেন, আমাদের সঙ্গে তাদের মোলাকাত হয়। সাইটে কিংবা সাইটের বাইরে। কাজের বিরতিতে কাছের যে বাজারে বা চায়ের দোকানে আমরা চা-সিগারেট খেতে যাই সেখানেও নানান মানুষের সঙ্গে কথা হয়। আমরা প্রতিদিন কাছাকাছি কোনো বাড়িতে প্রাকৃতিক কর্মাদি করতে যাই। কোনো বাড়িতে প্রতিদিনের ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি রাতের জন্য রেখে দিয়ে আসি। তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক। আলাপ। তর্ক। আমাদের কাজ ও উদ্দেশ্য নিয়ে অনেকের সন্দেহ, প্রশ্ন, আলোচনা। অনেক সময়ই বিরক্ত হই। কথা বলতে ইচ্ছে করে না। অন্যান্য সকল নৈমিত্তিক চাপের মধ্যে, উদ্বেগের মধ্যে, টাকাপয়সা নিয়ে দুশ্চিন্তার মধ্যে আলাপ থেকে দুরে সরে থাকি। অনেক দিনই সাইট থেকে ফিরে চুপচাপ বসে বা শুয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। তখনও সত্তায় ও স্মৃতিতে থাকে বিচিত্র মানুষের অভিব্যক্তি, মুখশ্রী আর ভাষা। নিত্যনৈমিত্তিকতার সম্পর্ক। বিশেষ সম্পর্ক। নির্বিশেষ সম্পর্ক।

বিরামপুরের মীর্জাপুরের পরে আমরা কাজ করি বিরামপুরের চণ্ডীপুরে। দিদার নামে একটি ছেলের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় ২০০২ সালে। সেইবার আমরা জরিপ করতে ওই গ্রামে গেছি। ক্লাশ সিক্সে পড়ে তখন। একটা বাইসাইকেল নিয়ে আমাদের সঙ্গে ঘুরত। ২০০৬ সালে খনন শুরু করার সময়। ও আমাদের কাজ দেখা ও কাজে সাহায্য করা শুরু করে। ওর বন্ধু মামুন, আহমেদ, রুবেল, রবিউলরা সাইট নিয়ে ঝামেলা মেটাতে কাজ করে। আমরা কাছের চায়না মাঠে ক্রিকেট খেলতাম। তখন আমাদের তেমন টাকা নাই। দিদারের বড় বোন ওর অনুরোধে আমাদের জন্য ওদের বাড়িতে রান্না করে দেওয়া শুরু করে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত ও আমাদের দলের অন্যতম সদস্য। মাঠকর্মের সকল কাজই শিখে গেছে। মাঝখানে বিয়ে করল পাশের গ্রামের একটি মেয়েকে ভালোবেসে। আমাদের শিক্ষার্থী আর এখন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক পলিন ওর উকিল বাপ হন বিয়ের সময়। মাঝখানে ও ক্যাম্পাসে আমার বাড়িতে এসে আমার সঙ্গে থেকেছে অনেক দিন। আমার পিএইচডি থিসিসের কাজ করার সময়। সুজন আমাদের সঙ্গে কাজ করত ওর ভাই কৃষ্ণদা ও মুকুলের সঙ্গে। পরে ও অনেক বছর আমাদের বিভিন্ন কাজে ছিল। এখন ও পল্লীবিদ্যুতের খুটি বসানোর কাজ করে। পরে একই জায়গায় খনন করি আবারও ২০১০ সালে। তখন আমাদের জন্য চ-ীপুরের কাছেই জয়নগরে বাড়ি ভাড়া খুঁজে দেয় দিদার, মামুন ও ওদের বন্ধুরা। গত বছরও আমরা ঈদ করেছি দিদার ও মামুনের বাড়িতে।

দিনাজপুরের বিরামপুর থেকে আমাদের কাজের শুরু। একটা ছোট হোটেল। মিজান হোটেল। ছোট ছোট ঘর। দুইটা টয়লেট। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮, ২৯ ও ৩০ ব্যাচ নবাবগঞ্জ, হাকিমপুর ও বিরামপুরের প্রাথমিক জরিপ করেছিল ওদের রেগুলার কোর্সের অংশ হিসাবে। এই হোটেলে থেকেছি আমরা সবাই। হোটেলের সামনের দিক ভেঙে এখন মার্কেট হয়ে গেছে। পেছনের দিকে ৩/৪ টা রুম এখনো রেখে দিছে। পরে আমি, সাজিদ, ঊর্মিলা আর ফাহিম ওই রুমগুলোতে থেকে আবারও কাজ করেছিলাম। সেই হোটেলের সামনের চায়ের দোকানের গরুর দুধের চা খেতে খেতে আড্ডা। সাকিব তখন আমাদের পথপ্রদর্শক। আমাদের ২৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী। এখন গ্রামীন ফোনের কর্মকর্তা। ওর হাত ধরেই আমাদের দিনাজপুরের কাজের শুরু। পাশের হোটেলে মালাই (দুধের সর) খেতে আমরা রাত ১১ টার দিকে যেতাম।

বিরামপুর ও নবাবগঞ্জে ২০০৬ ও ২০০৭ সালে খনন করার সময় রেল লাইনের কাছে একটা বাসা ভাড়া করা হয়। বাসা ভাড়া করে দিয়েছিল সাকিবেরই বন্ধুরা – মিলন, মশিউর, রিমন। বিরামপুরে ওদের একটা ক্লাব আছে। লুব্ধক। সেখানে আর আমাদের খাবার দোকান – আকবরিয়া হোটেলের সামনে আমাদের শিক্ষাথীরা ক্যারাম খেলত। দুই বছরই আমরা ৬-৭ মাস করে কাজ করেছি। ২০০৭ সালে শেষের দিকে আমরা খনন করি নবাবগঞ্জের দাউদপুরের চক জুনিদ-চক দিয়ানতের কালাডুগরি ঢিবিতে। ওই জমির মালিক আজিজ স্যার। থাকেন দারিয়াতে। ওখানে খনন করার সময়ও আমরা ছিলাম দারিয়া ইউনিয়ন পরিষদ বিল্ডিংয়ের নিচতলায়। আজিজ স্যার আমার দেখা অসাধারণ মানুষদের একজন। আমাদের উনি বলেছিলেন, ‘আমি আল্লার কাছে বলি মৃত্যুর আগে ওই প্রতœস্থানগুলোতে কী ছিল তা যেন আমি জানতে পারি।’ এমন আর্জি কোনো মানুষের হতে পারে আমি জানলাম। উনি দাউদপুর বালিকা বিদ্যালয়ের, সম্ভবত, প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক ছিলেন। যে কদিন দারিয়ায় ছিলাম উনার দেখভালে আমাদের কোনো সমস্যা হয় নাই। পরেও উনার বাড়িতে গিয়েছি ও দাওয়াত খেয়েছি। প্রার্থনা করি উনি যেন আরো অনেক দিন বেঁচে থাকেন।

প্রথম যখন আমরা খনন শুরু করি তখন মহাস্থান থেকে জব্বারভাই, ইয়াসিন ভাই ও ঠান্ডু ভাই আমাদের সঙ্গে থাকতেন। খননের কাজ করতেন। উনারা একেকজন ২০-২৫ বছর ধরে মহাস্থানসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতœতাত্ত্বিক খনন কাজ করেছেন। টাকা কম থাকায় তখন উনারা তিনজনই কেবল ছিলেন। উনাদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ১৯৯৯ সালে মহাস্থানে খনন কাজ করার সময়। ইয়াসিন ভাই মহাস্থানের পীর সুলতান মাহীসওয়ারের একজন মুরীদ ছিলেন। ভক্ত ছিলেন। অত্যন্ত রসিক মানুষ। কাজের ক্ষেত্রে অসম্ভব যতœশীল আর নিষ্ঠাবান ছিলেন। গত বছরের আগের বছরে উনি ইহলোক ত্যাগ করেন। জব্বার ভাইকে আমি মজা করে জব্বার খালা ডাকি। গত বছর কাহারোলেও উনি আমাদের সঙ্গে কাজ করেছেন। বয়স হয়ে যাওয়ায় আর শরীর ভারি হয়ে যাওয়ায় এবছরে বিরলের খননে আসতে পারেন নি। এখনে মহাস্থান থেকে ১৫-১৬ জন এসে পুরোটা খননের সময় থাকেন। এমন না যে উনারা খুব গরিব। প্রায় সবারই আয়ের সংস্থান আছে অন্যত্র। জমি আছে। ভ্যান আছে। কেউ ব্যবসা করেন। প্রতœতাত্ত্বিক খনন তাদের কাছে নেশার মতন। প্রায় সবাই অসম্ভব আড্ডাবাজ। রসিক। বিরক্ত হন না। প্রচন্ড গরমে, শীতে, কিংবা বৃষ্টিতে কখনো উনাদের আমরা মেজাজ হারাতে দেখি নাই। মাঝে মাঝে খুব অদ্ভুত সমস্যার বা সঙ্কটের মধ্যে আমাদের পড়তে হয়। আগে থেকে আঁচ করতে পারা যায় না। গত বছর যেমন। খনন করতে করতে একসময় একটা সাধারণ পাথর বের হয়ে আসে আংশিকভাবে। যে-কোনো পাথরকে ওই এলাকার লোকজন পাষান বলেন। মনে করেন সবই কস্টিপাথর। অনেক দামী। এই ভুল ধারণার ক্ষেত্রে স্থানীয় শিক্ষিত মানুষদের আর প্রতারকদের ভুমিকা প্রবল। খবরের কাগজের প্রতিবেদনে আমরা অনবরত পড়তে থাকি এত মন ওজনের, এত লক্ষ বা কোটি টাকা মূল্যের কস্টি পাথরের মূর্তি উদ্ধার। দীর্ঘদিন ধরে কস্টি পাথরের (বা সীমানা পিলারের) অলৌকিক ক্ষমতা থাকার নাম করে একাধিক প্রতারকচক্র মানুষজনকে ঠকিয়ে টাকা নিচ্ছে। কাহারোলের জয়ানন্দ বাজারে একজন শিক্ষিত ও প্রভাবশালী ব্যক্তি অনেকের সামনের আমাকে এই অলৌকিকত্বের বয়ান দেন। উনি নাকি একটি এমন পাথর পেয়েছিলেন যেটি দুধ-জল মিশিয়ে দিলে কেবল জল শুষে নেয়। চাল দিলে চালকে টেনে নেয়। ক্যামেরা দিয়ে ওই পাথরের ছবি তুলতে গেলে ক্যামেরার লেন্স ফেটে যায়। ওই পাথর কয়েকজন মিলে বিক্রি করেছিলেন আর উনি বার লক্ষ টাকা ভাগে পেয়েছিলেন।

এই যখন পরিস্থিতি তখন পাথর বের হওয়ার খবর বাতাসের আগে এলাকায় ছড়িয়ে পরে। আর মানুষজন পিলপিল করে জড়ো হয়। সবার কথা হলো, পাথরটা পুরোপুরি বের করে দেখাতে হবে ওটা কস্টিপাথর কী-না। শুভ, দিদার, সোহাগসহ মহাস্থানের অন্যান্য মানুষজনও তখন ছিলেন। কোনোভাবেই জড়ো হওয়া মানুষকে বোঝানো গেল না। তখন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শ্রী সত্যজিৎ রায় এলেন। তার কথাও মানুষ বিশ্বাস করলো না। বাধ্য হয়ে আমাদের পাথরটা পুরোটা বের করে দেখাতে হল। ঘটনা এখানেই শেষ হলে কথা ছিল।

দুই/তিন দিন পরেই আমরা সকালে এসে দেখি ওই পাথর যেখানে পাওয়া গেছে তার আশে পাশে দেয়াল ভেঙে কারা যেন ইট ভেঙে রেখে গেছে। রাতের বেলা যখন কিছু লোক খোড়াখুড়ি চালাচ্ছিল তখন তারা আশেপাশের ঘরের চালে ইট মারছিল। যাতে লোকজন মনে করেন যে ভূতেরা ওইখানে জড়ো হয়েছে। পরে আমরা পাহারার ব্যবস্থা করি। মানুষজনের সঙ্গে বিশেষ করে আমাদের সঙ্গে ওই গ্রামের যে-কজনা কাজ করছিলেন তাদের সঙ্গে কথা বলি। অনেক আলাপ করি। ভূতের উৎপাত বন্ধ হয়ে যায়।

ওই গ্রামের সম্পর্ক নিয়ে আর সম্পর্কের মধ্যে সত্তা পরিবর্তন নিয়ে একটা মহাবৃত্তান্ত লিখে ফেলা সম্ভব। এখন সেটা পরের জন্য তোলা রইল। তবে একটা কথা না বললেই নয়। কাহারোলের মাধবগাঁও বুরুজে খনন শুরু করতে আমাদের বেগ পেতে হয়েছে। শুভ, সোহাগ, দিদার, ঠান্ডুভাই, সত্যজীৎদা সহ কেউই প্রথমদিকে গ্রামের মানুষের আস্থা পাচ্ছিলাম না। গ্রামের মানুষের বিশ্বাস ওটা দেবতার থান। ওখানে খনন করলে দেবতা ক্ষতি করবেন। আমরা তাদের বিশ্বাসে আঘাত দেই নাই। তারা দেবতা ভর করিয়ে আমাদের দেখাতে চেয়েছেন যে আমাদেরও কত বড় ক্ষতি হতে পারে। পরে স্থানীয় সংসদ সদস্য মনোরঞ্জন শীল গোপালের হস্তক্ষেপে আর আমাদের যোগাযোগের ধরনের কারণে তারা অনুমতি দেন। কিন্তু শর্ত জুড়ে দেন যে, গ্রামের কেউ আমাদের সঙ্গে কাজ করবে না। প্রথমে খুব সমস্যা হচ্ছিল। পরে আস্তে আস্তে ওই গ্রামের অনেক মানুষই আমাদের সঙ্গে কাজ করা আরম্ভ করেন। এক্ষেত্রে ওই গ্রামের এক নারীর অসামান্য ভূমিকা ছিল। তিনি রেনু রানী রায়। তাকে নিয়ে পরে আবারও লিখতে হবে। মাধবগাঁওয়ের সেই মানুষগুলোই এবারও বিরলে রোজ অটোতে করে এসে আমাদের সঙ্গে কাজ করছেন।

জরিনা জিনের বাড়ি। একটি প্রত্নতাত্ত্বিক ঢিবির উপরে মানুষজন জিনের জন্য পুরানো ইট দিয়ে এই ঘরটি তৈরি করে দিয়েছেন।

ঘোড়াঘাটের বেলওয়ায় খনন করার সময় স্থানীয় সাংবাদিক জিল্লুর ভাই আমাদের সার্বিক সহযোগিতা করেছিলাম। ওইবার মহাবিপদে পড়েছিলাম। যে সাইটে কাজ করতে চেয়েছিলাম সেই সাইটের কাছে বাসা ভাড়া নেয়া আর সাইটের ম্যাপিং করার পরেও স্থানীয় মানুষজনের আপত্তির কারণে আমরা কাজ শুরু করতে পারি নাই। খননের ক্যাম্প হিসাবে ভাড়া নেয়া বাসা ছেড়ে সাত দিনের নোটিশে আমরা বেলওয়ায় খনন শুরু করি। জিল্লুর ভাইসহ স্থানীয়দের সহযোগিতা ছাড়া আমরা ওখানে খনন করতে পারতাম না।

খননে স্থানীয় কর্মীদের ব্যবস্থাপনায় ছিলেন জিল্লুর ভাই। দ্রুত বাসা ভাড়ার ব্যবস্থা করা। প্রশাসনের সহযোগিতা। সাইটটি খাস জমি হিসেবে বন্দোবস্ত দেওয়ার কারণে বন্দোবস্ত নেয়া মালিকের সঙ্গে সমঝোতা। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ অনেকেই সাহায্য করেন নানাভাবে। বেলওয়ার পাশাপাশি গোপালপুরের একটি পুকুরের মধ্যে খনন করে আমরা একটি জল-স্থাপনা পাই। ওখানেও বিচিত্র সব গল্প প্রচলিত ছিল। ওই জমির মালিক মুসলমান হলেও তিনি একজন হিন্দু নারীকে বিয়ে করেন। পুকুর খোড়ার সময় অনেকগুলো পাথরের তৈরি প্রতীমা পাওয়া যায়। স্থানীয় মুসলমানদের ভাষ্যমতে, হিন্দু স্ত্রীর প্ররোচনায় তিনি মূর্তিগুলোর পূজোর ব্যবস্থা করেন। পূজোর জেরে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ে মৃত্যুবরণ করেন। আমি আমার বেশকিছু লেখায়, আমাদের সাম্প্রদায়িক সত্তার গঠন ব্যাখ্যা করার জন্য লোকমুখে প্রচলিত কাহিনিগুলোর আর পরস্পরবিরোধী কথ্য ইতিহাসের ভাষ্যেও উদাহরণ ব্যবহার করেছি। গল্পগুলো সত্য কি, মিথ্যা সেটা জানা নাই। জানাটা গুরুত্বপূর্ণও না। তবে এই কাহিনিগুলো যে-ভাবে ডালপালা মেলে, ধর্মীয়সত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে আখ্যানভাগ বদল করে সেটা আমাদের জনচৈতন্যে বিদ্বেষ ও ঘৃণার সুগভীর বিস্তারের দিকে আমাদের নজর ফেরাতে পারে। একইসঙ্গে, পরিস্পরিক মেলবন্ধনের সূত্র হাজির করে জয়পুরহাটের পা^ঁচবিবি উপজেলার পাথরঘাটার নিমাই পীরের মাজার ও সেই মাজার কেন্দ্রীক ওরস ও বারুনী ¯œান। কিংবা আমাদের চলমান খননের স্থানে বুড়ি দেবীর থানের পাশাপাশি সত্যপীরের থানের আর কাছেই মুলুক দেওয়ানের মাজারের সঙ্গে সত্যপীরের থানের সম্পর্ক। পারস্পরিক বিদ্বেষ আর সহনশীলতা কোনো সরলরৈখিক পথ ধরে বিকশিত হয় না। সম্পর্কের বিচিত্র ও বিবিধ শর্তের মধ্যেই আমাদের পরিচয়ের ও সত্তার রাজনীতি আকার পায় ও গঠিত হয়।

বোচাগঞ্জের ইটাকুড়া ঢিবিতে কাজ করতে গিয়ে আলাপ হল সুকুমারদা, সাজ্জাদভাই, ইছামউদ্দিন ভাইসহ আরো কত মানুষের সঙ্গে। খাস জমিতে গুচ্ছগ্রাম করে দেয়া হয় একসময়। সেখান থেকেই অনেকে বন্দোবস্ত পান। অনেকে বন্দোবস্ত ছাড়াই থাকেন। সাইটের মাটি স্থানীয় লোকজন, হিন্দু বা মুসলমান নির্বিশেষেই, খুঁড়ে নিয়ে যান। স্থানীয় প্রভাবশালী ইটভাটার মালিক সাইটের মাটির একটা অংশ কেটে নিয়ে গেছেন। ওই গুচ্ছগ্রামে থাকা বেশিরভাগ মানুষই খুব গরিব। ইছামউদ্দিন ভাই আমাদের স্থানীয় কর্মীদের যোগার করে দেন। তার ছোট ছেলে শাকিল। তখন ক্লাশ ফাইভে পড়ে। আমাদের সঙ্গে থাকে। একদিন সকালে গিয়ে দেখি সে নিজ উদ্যোগে নিজের খাতার পৃষ্ঠা ছিড়ে রংপেন্সিল দিয়ে লিখেছে ‘দেয়ালের উপরে কেউ উঠবেন না/ইট ভাঙবেন না’। সেই কাগজ কাঠির সঙ্গে লাগিয়ে সাইটের একজায়গায় গেঁথে রেখেছে।

সুকুমার দা কীর্ত্তন গান করেন। বাসুদেবপুর বাজারে একটা টেবিলের উপরে পান-বিড়ির দোকান করেন। বছরের একটা সময়ে তার র্কীর্ত্তনের দল নিয়ে বায়নায় বিভিন্ন জায়গায় যান। সাথীও তখন ক্লাশ ফাইভে পড়ে। ওখানে দুইটি ছেলে গ্রামের বাচ্চাদের নাচ শেখান। সাথী সেই নাচের দলের একজন। এই বয়সেই ওর বিয়ের তোড়জোড় চলতে দেখেছিলাম। ওর স্কুলের হেডমিস্ট্রেসকে আমরা অনুরোধ করে এসেছিলাম যেন ওর বিয়ের চেষ্টা করা হলে আমাদের জানান। আশার কথা, এখনো ওকে বিয়ে দেওয়া হয় নাই।

শহীদুল ভাই আমাদের অটোতে করে নিয়ে যান। নিয়ে আসেন। কখন থেকে উনি সাইটে আমাদের সঙ্গে থাকা শুরু করেন। তার অটের সাউন্ডবক্সে আমরা গান শুনি। তিনি বিভিন্ন কাজে আমাদের সঙ্গে হাত মেলান। শহীদুল ভাইয়ের একটি দারুণ লালনগীতির কালেকশন আছে। তিনি নিজে যে একটি গানের দলের সদস্য তা আমরা জানি আরো পরে। দোতারা বাজান।

প্রত্যেকদিন সাজ্জাদভাইয়ের দোকানে আমরা ছোলা, মুড়ি খেতাম। সোলার প্যানেলের ফ্যানের বাতাস খেতাম গরমের মধ্যে। ইছামউদ্দীন ভাইয়ের বড় ছেলে ওই দোকানে কাজ করত। বয়স বড়জোর ২২/২৪। এবারে শুনি সে নাকি তৃতীয় বারের মতন বিয়ে করেছে।

আমাদের কাজের মধ্য নিয়ে, সম্পর্কের মধ্য দিয়ে সম্পর্কিত সকল পক্ষের সত্তার পুনর্গঠন হতে থাকে। বিভিন্নভাবে। অংশীদারিত্বমূলক সত্তার গঠনের ইতিহাস যেমন আত্মজৈবনিক, স্মৃতিমন্থনকারী তেমনই ব্যাখ্যামূলক। ইটাকুড়া ঢিবিতে কাজ শুরু করার সময়ও স্থানীয় মানুষজন আমাদের নিরুৎসাহীত করার চেষ্টা করেছেন দৈবশক্তির রোষানলে পড়ার ভয় দেখিয়ে। তারা যে কোনো কৌশলের অংশ হিসেবে এই ভয় দেখান তা কিন্তু না। এমন প্রতিটি প্রতœস্থানের সঙ্গে স্থানীয় মানুষের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক একদিকে যেমন প্রতœস্থানগুলোকে দৈব/অলৌকিক ক্ষমতা বা ক্ষমতার অধিকারী/অধিকারীনী পীর, দেবতা, দেবি, জ্বিন, ভূত প্রমুখের বাসন্থান হিসাবে চিহ্নিত করতে ভূমিকা রেখেছে তেমনই স্থানীয় ক্ষমতাবান ও ভূমিদখলকারীদের হাত থেকে ওই জমি/স্থানকে বাঁচাতে এই চিহ্নায়নকে তারা ব্যবহার করতে চেয়েছেন। তবে অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন। তাদের সত্তার যে মাত্রাটি এখানে সংখ্যালঘুর ও দরিদ্র মানুষদের জমি দখল করার, জাল দলিল করে হস্তগত করার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে বিকশিত হয়েছে, সেই সত্তা ওই স্থানের মাটি খুড়ে নিয়ে গেছে। দখল করে জমি বানিয়েছে। একই সত্তার বিবিধ ও পরস্পরবিরোধী প্রকাশ। যে স্থানীয় ভূমিদস্যুর ক্ষমতা, অর্থ ও নেটওয়ার্কের কাছে অনুগত ও বশ্য, সেই আবার অন্য পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করছে অলৌকিক শক্তিকে আশ্রয় করে।

ইটাকুড়া ঢিবি নিয়ে আমরা কাজ শুরু করার আগে স্থানীয় তরুণদের মধ্যে বিবাদ ছিল। একদল ঢিবির একাংশকে পীরের থান বানিয়ে বিভিন্ন নেশা করত বলে অভিযোগ একদলের। অভিযোগকারীরাই পাল্টা ডিসকোর্স তৈরি করতে গিয়ে ওখানে একটি দেবতার থান তৈরি করেন। যারা ওই থান তৈরি করেন তারা কিন্তু দেবতার অধিষ্ঠানে বিশ্বাসী মানুষজন। এমন নয় যে, থান তৈরি করার ঘটনাটি নিতান্তই আপতিক ও কৌশলগত। এই মানুষদের একটা অংশ প্রথমদিকে যেমন আমাদের বাধা দিয়েছেন, আবার আরেকটা অংশ আমাদের কাজে সাহায্য করেছেন। কেউ কেউ শুরুতে বাধা দিলেও, পরে সর্বোচ্চ সাহায্য ও সহযোগিতা করেছেন। খননের সময় বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের উপস্থিতি, প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্কিত মানুষজনের সংশ্লিষ্টতা, প্রচারমাধ্যমের সংবাদ প্রকাশ আর স্থানীয় সংসদ সদস্যের উপস্থিতি এই পক্ষের প্রতিরুদ্ধ সত্তার বিকাশের অনুকূল হয়ে উঠেছিল। একই মানুষের মধ্যে বিরাজমান দুই বা ততোধিক সত্তার মধ্যে একটি প্রবল হয়ে ওঠে, স্বীকৃতি পায়, প্রকাশ্য হয়ে উঠতে পারে আমাদের উপস্থিতি, স্থানের নতুনতর সম্পর্কিতকরণ, আর অন্যান্য মানুষের উপস্থিতির মধ্য দিয়ে। আমরা চলে আসার পরে দুটো ঘটনা ঘটেছে। আমরা খননকৃত স্থান মাটি দিয়ে পুনরায় ভরাট করে দিয়ে আসি সংরক্ষণের প্রয়োজনে। আমরা চলে আসার পরে আগের দেবতার থানটি আবার নতুন কলেবরে পুনর্স্থাপিত হয়েছে। সেখানে পূজো হচ্ছে, কীর্ত্তন হচ্ছে। পুরানো মন্দির খুঁজে পাওয়ার স্থানীয়দের দেবতার থানের একধরনের স্বীকৃতি লাভের বহির্প্রকাশ হিসাবে এই পুনর্স্থাপনকে ব্যাখ্যা করা যায়। একইসঙ্গে, স্থানীয় একজন হিন্দু ভদ্রলোক মাটি দিয়ে ভরাট করা সাইটের কিছু জায়গা দখল করে আমগাছ লাগিয়েছেন। ওই ভদ্রলোকও কিন্তু সাইটের উপরের মন্দিরে নিয়মিত পূজো দেন। একইসঙ্গে জমিও ভোগদখর করেন। পরস্পর যুযুধান সত্তাসমূহের সম্পর্কের বদল ও নতুন গঠন এভাবেই সম্ভব হয়ে ওঠে একটি প্রত্নস্থানে কাজের ইতিহাসের ভিন্ন পাঠে।

গত পনের বছরে এই সম্পর্কমালার অভিঘাত কেমন আমার সত্তা গঠনে? যে-মায়ার জাল আমাদের ঘিরে তৈরি হয় সেই জাল স্মৃতি হয়ে সত্তার মধ্যে শিকড় গেড়ে বসে যায়। ওই সময়ের ফটোগ্রাফ দেখি। প্রতিটি সংশ্লেষ মনে পড়ে যায়। কোনো মানুষের নাম মনে আছে। কারো নাম মনে নাই। ভুলে যাওয়ার অপরাধবোধে আক্রান্ত হই। মনে হতে থাকে, শিক্ষিত ও শহুরে পরিম-লে গঠিত সত্তার গঠনে ভুলে যাওয়া আর স্মৃতিকাতরতাই হয়ত স্বাভাবিক।

১১ আগস্ট, ২০১৭।১৩, ব্যাচেলরস কোয়ার্টার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

Blog at WordPress.com.

Up ↑

%d bloggers like this: