বর্তমানে, সংশয়ে, অতীতে (উদ)যাপন
স্বাধীন সেন
এক.
ফিল্ড ওয়ার্ক করতে গেলে এমনটা ঘটা স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। জরিপ করতে গেলে আমাদের অসংখ্য মানুষের সঙ্গে আলাপে লিপ্ত হতে হয়। অনিবার্যভাবেই। স্বেচ্ছায়-অনিচ্ছায়। কোনো অচেনা এলাকার পুরানো ইট, খোলা (উত্তর বঙ্গের আঞ্চলিক ভাষারীতিতে মৃৎপাত্রের টুকরাকে এই নামেই ডাকা হয়), ঢিবি (ধাপ/আড়া/কুড়া/বুরুজ ইত্যাদি স্থানীয় নামে পরিচিত), দহ, বিল, কান্দর (বিলেরই আরেক নাম) খোঁজ করতে হলে মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হয়ই। অপরিচিত, শহুরে ভঙ্গিতে অন্য ভাষারীতিতে কথা বলার কারণেও মানুষজন বুঝে যায় যে, আমরা ‘অন্য’ জায়গার মানুষ, শহুরে মানুষ। আমাদের বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। জানতে চান কী-করতে আমরা গিয়েছি। আমরাও প্রশ্ন করি। জরিপের সময় আমরা সাধারণত কোনো বাজার বা হাটের কোনো জমজমাট দোকানকে প্রথমে বেছে নেই। সেখানে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করাটা সহজ তুলনামূলকভাবে। অনেককে একসঙ্গে পাওয়া যায়। আলাপ করা যায়। টিভি বা টিভিতে ডিভিডিতে চলা সিনেমা দেখতে দেখতে। চা খেতে-খেতে। আবার, অনেকের সঙ্গে কথা বলার বিপদও থাকে। ভিন্ন ভিন্ন ধরনের মানুষের জিজ্ঞাস্য আলাদা। তাদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার পদ্ধতি, ধরন ও প্রকৃতিও আলাদা। এ-এক জটিল ও আশ্চর্য মোকাবেলা।
কখনো খুঁজে বের করি মুরুব্বিদের, যারা পুরানো ও স্থানীয় মানুষ। এলাকার পুরানো জিনিসপত্র সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখেন। তারা জানাতে পারেন, কোন গ্রামের জমিতে চাষ দিতে গেলে ইট, আর ইট। চাষ দেওয়া যায় না। তারা জানেন, কোন গ্রামের কোনদিনের বাঁশঝাড়ের নিচ দিয়ে ইয়া মোটা বড় বড় থান ইট দিয়ে বানানো দেয়াল চলে গেছে। অনেকে বলতে পারেন, কোন জমিতে খোলা ও কুচি (লোহার ধাতুমলকে কুচি বলে) গিজগিজ করছে। কোন জায়গায় কোনো এক কালে মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল। সেটা লক্ষ লক্ষ টাকায় কেউ বিক্রি করে দিয়েছে। কোনো পুকুরের পাড়ে খুঁড়তে গিয়ে কলস ভর্তি সোনা বা রূপার পয়সা পাওয়া গেছে। তা বিক্রি করেই কোনো এক বা একাধিক জন দালান বানিয়েছেন।
আমাদের পারস্পরিক কথনে আমরা শুনি আরো নানান কাহিনী। প্রত্নস্থানের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের বিচিত্র অভিমুখ, বদল ও আত্মপরিচয়ের সংযোগের নানান বয়ান। এসব বৃত্তান্তর মধ্য থেকে কোন ঘটনা কী-ভাবে ঘটেছিল, আদৌ ঘটেছিল কী-না, তা জানা ও বোঝা মুশকিল হয়ে পড়ে। আবার, ঘটনার সত্যতা বা অসত্যতা জানা আদৌ জরুরি বলে মনেও হয় না। সত্য বা মিথ্যা, ফ্যাক্ট বা ফিকশন, অতিকথন/মিথ বা ইতিহাস – এই যে হরেক বৈপরীত্যবাদী জানা- বোঝার তরিকা আমরা মেনে চলি, সেগুলো দিয়ে কি বর্তমান ও অতীতের সংযুক্তি (ও বিযুক্তিকে) আমলে নেয়া যায় ঠিকঠাকভাবে? দুনিয়াদারি সম্পর্কে আমাদের দৈনন্দিন বোঝাপড়া, দুনিয়াদারির সঙ্গে আমাদের নৈমিত্তিক মোকাবেলা, অসমতা-হিংসা-বিদ্বেষ-নিপীড়নের আর বাসনা-কামনা-লোভ-ইতরপনার নিত্যকার, প্রচ্ছন্ন অভিব্যক্তিসমূহের সঙ্গে আমাদের একটা ফয়সালা করতে চাওয়া বা না-চাওয়া কি এই অনুমিত ও স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নেয়া ঠিক আর বেঠিকের স্পষ্ট ভেদ মেনে চলে? চলে না বলেই আমরা এই কাহিনীর জালে জড়িয়ে পড়ি।
দুই.
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে অনেক পুরানো ঢিবি/স্থান স্থানীয় মানুষজন দেবতা/ঠাকুরের থান, কিংবা কোনো পীরের মাজার হিসাবে বিবেচনা করে। জিন বা পরীর কাহিনীও অনুপস্থিত নয়। এসব স্থানে নিয়মিত ধর্মাচরণ হয়। বাৎসরিক মেলা হয়। উৎসব হয়। প্রত্যেকটা প্রত্নস্থান ঘিরে আছে কাহিনি । কাহিনিগুলো সংশ্লিষ্ট দেবতা-পীরদের অলৌকিক কীর্তি সম্পর্কিত। কিংবদন্তীর রাজা-সেনাপতিসহ নানা চরিত্রের আনাগোনা এসব কাহিনীতে। পৌরাণিক চরিত্রও কাহিনীর মধ্যে ঘুরেফিরে আসে। সকল কাহিনী এক লেখায় লিখে ফেলা সম্ভবও নয়। তবে কয়েকটি এখানে বলাই যায়।
দিনাজপুরের বিরামপুরের মীর্জাপুরের জম্বুলেশ্বর মণ্ডবে বসে চৈত্র সংক্রান্তির মেলা। মÐবটি আসলে একটি ঢিবির উপরে ঔপনিবেশিক আমলে জমিদারের তৈরি করা শিব মন্দির। স্থানীয় মানুষজন জানান, বেশ কয়েকবার শিবলিঙ্গটি তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে চোরাকারবারীরা। কিন্তু দেবতা এমনই জাগ্রত যে কপিকল এনে শিকল দিয়ে বেঁধেও শিবলিঙ্গটিকে নড়ানো যায় নি। সেতাবগঞ্জে পাওয়া একটি বুদ্ধ প্রতীমা সতীমান ঠাকুর হিসাবে পূজিত হন। আ ক ম যাকারিয়া জানান যে, সত্যমান থেকে অপভ্রংশ হয়ে সতীমান নামটি এসেছে। একটা জায়গার নামই সতীমানডাঙ্গী। সতীমান ঠাকুরের ভিটা। সেখান থেকে তিনি চলে এসেছেন এখনকার মন্দিরে। এই আসা উপলক্ষে প্রতিবছর বড় মেলা হয়। বুদ্ধ প্রতীমাটি বেশ বড় (উচ্চতা ১২২ সেমি, প্রস্থ ৮৪ সেমি)। এই বুদ্ধ প্রতীমাটির মাথা আশির দশকের শেষে বা নব্বইয়ের দশকের শুরুতে কেটে নিয়ে যাওয়া হয়। ঠাকুরের জাগ্রত শক্তির কারণে গোটা প্রতীমা দুবৃত্তরা নিয়ে যেতে পারে নাই। এখন সিমেন্ট দিয়ে তাঁর মাথা তৈরি করে নেয়া হয়েছে। জরিপে আমরা জানতে পারি, সতীমান ডাঙ্গীতে একটা বড় ঢিবি ছিল। স্থানীয় প্রভাবশালী এক লোক সেই ঢিবি কেটে সেখানে এখন চাতাল বানিয়েছেন। ঢিবিটির আকার অনুমান করা সম্ভব আর আকার থেকে অনুমান করা সম্ভব যে, ঢিবিতে সম্ভবত একটি বৌদ্ধ বিহার ও মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ ছিল।

বিরামপুরে চুনা পীরের থান আছে। সেখানে মেলা বসে। মেলায় ভক্ত/মুরীদবৃন্দ একটি বড় শালগাছের গোড়ায় মানত করে চুন লেপে দেন। কাছেই আশুড়ার বিলে আর নলশীশা নদীর পাড়ে তর্পনঘাটে হয় বারুণীর স্নান। একই স্নান হয় পাঁচবিবির পাথরঘাটায় নিমাই পীরের দরগায়। পুরো দরগাটি গড়ে উঠেছে তুলশীগঙ্গা নদীর পাড়ে একটি ঢিবির উপরে। সেখানে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবাই মেলায় যান। সিরনি দেন।
মহাস্থানগড়ের পাশে করতোয়ার প্রায় মৃত ক্ষীণকায় প্রবাহে প্রতিবছর হয় স্নান। করতোয়া-মাহাত্ম্যমের মহাস্থানের যে-সকল অলৌকিক গুণাবলির কথা উল্লিখিত হয়েছে সেই গুণাবলি উদযাপিত হয় এই স্নানে। তর্পনে। মহাস্থানের অতীত আধুনিক প্রত্নতত্ত্ব যে বয়ানেই হাজির করুক না কেন জনপরিচয়ে এই অতীতের যাপন অনেকটাই ভিন্ন। তার আরো নানান উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।

নবাবগঞ্জ উপজেলার চকজুনিদ-চক দিয়ানতে রয়েছে বেশ কিছু ঢিবি। এসব ঢিবির মধ্যে অরুণ ধাপে খনন করেছে প্রতœতত্ত¡ অধিদপ্তর। সেখানে একটি বৌদ্ধ বিহার পাওয়া গেছে। পাশেই কালা ডুগরীর ধাপে আমরা ২০০৭ সালে খনন করে পেয়েছি একটি পঞ্চরথ হিন্দু মন্দির। ওখানে আরেকটি সংরক্ষিত বড় আকারের ঢিবি – যার স্থানীয় নাম কাঞ্জীর হাড়ী – বেহুলা-লক্ষ্মীন্দরের বাসরঘর নামে পরিচিত। একদিকে বেহুলার কাহিনীর মধ্যে ঢুকে পড়ে বান রাজার কাহিনী। এই কাহিনী অনুসারে এখানে বান রাজার প্রাসাদ বা রাজধানী ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অনেক প্রত্নস্থানের সঙ্গেই বেহুলা-লক্ষ্মীন্দরের কাহিনির সংযোগ ঘটে জনপরিসরে। যেমন, মহাস্থানের গোকুল মেধ – যেখানে খনন করে একটি বৌদ্ধ স্তুপের উপরে হিন্দু মন্দির পাওয়া গেছে – বেহুলা-লক্ষ্মীন্দরের বাসরঘর হিসাবে পরিচিত।

বিরামপুরের চণ্ডীপুরের তিলেশ্বরীর আড়ায় আমরা খনন করি ২০০৭ সালে। কাহিনী বলে আমাদের ভয় পাইয়ে খননে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিংবা হয়ত, স্থানীয় মানুষজন সেই কাহিনী সত্য বলে মনে করেন বলেই আমাদের সাবধান করে দিতে চেয়েছেন। এই লোকশ্রুতি অনুসারে, ঢিবির দক্ষিণ পাশে অবস্থিত এক বাড়ীর এক লোককে রাতে দেবী স্বপ্নে দেখিয়েছেন যে ঢিবিতে সোনার কলস আছে। তবে সেটা নেয়া যাবে না বলে দেবী জানান। কিন্তু লোকটি, যিনি মুসলমান, লোভের বশবর্তী হয়ে রাতে ওই কলস খুঁড়ে উঠাতে যান। দেবী ক্রোধান্বিত হয়ে তাকে চড় মারেন। লোকটি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তারপরে লোকটি আর স্বাভাবিক হন নাই। একসময় ওই অবস্থাতেই তিনি মারা যান। এখন, এই কাহিনী একদিকে যেমন মন্দির ও দেবীর বয়ানের আড়ালে হিন্দু-মুসলমানের বিরোধের দিকে প্রচ্ছন্নভাবে ইঙ্গিত করে, ঠিক তেমনি ওই বয়ান বর্তমানে মুসলমান-হিন্দু-সাঁওতাল নির্বিশেষে সবাই বিশ্বাস করেন।

বোচাগঞ্জের ঈষানীয়া ইউনিয়নের জিনুরে একলোক একটি ঢিবি কেটে ইট তুলে নিয়ে গেলে, এক জিন তাকে রাতে স্বপ্নে এসে বলেন, ‘তুই আমার থাকার জায়গাটা নস্ট করে ফেললি! এখন আমি বৃষ্টির মধ্যে কোথায় থাকব?’ স্বপ্নাদীস্ট হয়ে লোকটি জরিনা নামের ওই জিনের জন্য খুড়ে তোলা ইট দিয়েই উপরে খড়ের ছাউনি দিয়ে বানিয়ে দেন একটি ঘর। স্থানটার নাম এখন জরিনা জিনের বাড়ি। কাছেই আরেক ঢিবির উপরে জঙ্গল। ওই জঙ্গলের একদিক থেকে ছাগল ঢুকে নাকি অপর পাশ দিয়ে গরু বা মহিষ হয়ে বের হয়। লোকজন তাই ভয়ে ওই ঢিবিতে কখনো যান না। তবে ঢিবির উপরে তাজা মনুষ্য মল দেখে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম সবাই ভয় পান না।


তিন.
আমরা তো এই বৃত্তান্তের দুনিয়ায় ঢুকে পড়া এড়াতে পারি না, যতই ‘উচ্চবর্গকে’ প্রতিনিধিত্ব করি না কেন। জরিপ ও খননের সময় কাহিনীর এই দুনিয়ায় আমাদের বসবাস করতে হয়। এই দুনিয়ার সঙ্গে মোকাবেলা করতে, করতে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা করতে হয়। জনশ্রুতিকে তুচ্ছ না করে নিজেদের কাজ করে যেতে হয়। এই কাজের মধ্য দিয়ে আগের জনশ্রুতি পাল্টে যায়, পরিমার্জিত হয় ও নতুন করে শক্তিশালীও হয়ে ওঠে অবধারিতভাবে। সেই বদলে যাওয়ায় গল্প বলব অন্যত্র।
নিজেদের অনেকসময় কলোনিয়াল এথনোগ্রাফারদের মত মনে হতে পারে প্রায়শই। মনে হয়, প্রবল, উৎকৃষ্ট ও যুক্তবাদী ‘নিজ’ সত্তা নিয়ে আমরা ‘অন্য’ সত্তার জীবন-যাপন দেখছি, বোঝার চেষ্টা করছি আর কোনো না কোনো ভাবে বিচার করছি – যুক্তির আর কালানুক্রমিক কাহিনীবিন্যাসের ইতিহাসের বাইরের এই ‘কল্পিত’ ইতিহাস তো কুসংস্কার, মিথ্যা। এই মনে হওয়াকে অনুশীলনের মধ্য দিয়ে মোকাবেলা করার পরেও ‘নিজ’ ও ‘অন্যর’ সম্পর্ক বদলে যায়। নতুন সত্তার উদ্ভাস ঘটে। কাজের মধ্য দিয়ে। এখানে সেই বৃত্তান্তে না ঢুকেও, আমরা স্মরণ করতে পারি আশীষ নন্দীর দারুণ একটি লেখা। ‘ইতিহাসের বিস্মৃত দ্বৈততা’ (হিস্টোরিস ফরগটেন ডাবলস)।১ আমাদের আধুনিক, যুক্তনির্ভর আর স্পষ্ট কালপরস্পরা ভিত্তিক ইতিহাস আর অতিকথন/মিথগুলোর মধ্যে ভেদরেখা টানা সবসময় কেবল মুশকিলই নয়। কখনো কখনো অসম্ভবও বটে। জনজীবনে প্রায়শই গল্প/কাহিনী/মিথগুলো ‘যৌক্তিক’ ইতিহাসের সঙ্গে মিলে মিশে থাকে। লেপ্টে যায়। আমাদের ‘শিক্ষিত’, নাগরিক ইতিহাস-সংবেদনেও কি অতীন্দ্রিয়ের প্রকাশ ঘটে না?
প্রচারমাধ্যম আর অপরবাস্তব/ভার্চুয়াল জগতে প্রতিনিয়ত সত্য আর মিথ্যার ভেদরেখা যেভাবে অস্পষ্ট হতে থাকে, তাতে করে ফ্যাক্ট আর ফিকশনকে আমরা পৃথক করতে পারি না; করতে হয়ত চাইও না; চাইলেও হয়ত পারিও না। অস্পষ্টতা ও সংশয়ের সঙ্গে আমাদের নাগরিক চৈতন্যের যে নিত্যযাপন, তাকে তো আমরা ‘কুসংস্কার’ বলি না! উগ্র জাতীয়তাবাদীরা যখন কিংবদন্তী/মিথের ঘটনাবলির প্রতœতাত্তি¡ক ও ঐতিহাসিক সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির করে সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদকে এবং তার সহিংসতাকে জায়েজ করতে চায় তখন, লক্ষ, লক্ষ মানুষ সেই বিদ্বেষ-সহিংসতার অংশীদারী হয়ে ওঠেন। ‘মিথ’ ও ‘বস্তুগত প্রমাণের’ এই মেলবন্ধনকে আমরা তো খারিজ করি না। এই অস্পষ্টতার ও সংশয়ের আবর্তে পতিত হই, সহিংসতা আর নিপীড়নের অংশীদারী হয়ে উঠি। ‘যৌক্তিক’ ও ‘বৈজ্ঞানিক’ প্রতœতত্ত¡-ইতিহাস লেখার ও পড়ার নামে শাস্ত্রীয় ও জনপরিসরে ভ্রান্তি ও বিকৃতি ছড়িয়ে পড়ে স্বাভাবিকীকৃত হয় আমাদের এই মোটাদাগে যুক্তি আর বিশ্বাসের জগতকে পৃথক করে তোলার কারণে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের উছিলায় সম্পুর্ণ ভ্রান্ত ও ভয়ংকর নিপীড়নমূলক ধারণা ও অনুশীলন বৈধতা পায়; ঠিক যেমন বর্ণবাদ একসময় বৈধতা পেয়েছিল; বহিরাগত আর্যত্বের ধারণার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়েছিল; আর্যরা স্থানীয় ও শ্রেষ্ঠ জাতি ছিল এবং এ-অঞ্চলে সভ্যতার উদ্ভব ঘটিয়েছিল এমন ধারণা স্বীকৃতি পেয়েছিল। বিষয়টি বোঝার জন্য মোহেনজোদারো নামের সাম্প্রতিক হিন্দি সিনেমাটি দেখতে পারেন; কিংবা লক্ষ করতে পারেন যে, রাখিগড়ি নামের বর্তমান ভারতের হরিয়ানায় অবস্থিত একটি হরপ্পীয় সভ্যতার প্রতœস্থানে আদি-অধিবাসী ও বর্তমান অধিবাসীদের মধ্যে অব্যাহত জাতিগত ধারাবাহিকতা ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে বৈজ্ঞানিকীকৃত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ-প্রচেষ্টা নিসংশয় ও অভ্রান্ত নয়। এই চেষ্টার মধ্যে হিন্দুত্ববাদের ‘প্রাচীনত্বের সমসাময়িকতা’ প্রমাণ করার আখ্যান স্পষ্ট। সাম্প্রতিক ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদের বয়ানের অংশ হিসাবে প্রতœতত্ত¡ ও ইতিহাসকে বদলে ফেলার অপচেষ্টা হিসাবেই এই ‘বৈজ্ঞানিক’ প্রতœতত্ত¡ চর্চার প্রবণতাগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। এক্ষেত্রে মিথ ও যুক্তির যুথবদ্ধতা প্রকাশ্য। সবক্ষেত্রে, অতিকথন/মিথ আর যুক্তনিষ্ঠ প্রতœতত্ত¡-ইতিহাসের সীমানাকে বিলীন করাও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। অর্থাৎ, সমাজবিজ্ঞানী হিসাবে কোথায় বর্গবিভাজনগুলোর সীমানা স্পষ্ট, আর কোথায় অস্পষ্ট সেটা বিশ্লেষণ করাও আমাদের জরুরি কাজ হতে পারে। বিষয়টি নিয়ে বিশদ আলোচনা করব অন্য কোনো লেখায়। তবে প্রাথমিক ভাবে, বর্তমান লেখকের ব্যাকুল বাসনা বইটি পড়ে দেখতে পারেন।২
কয়েকদিন আগে স্টার জলসায় প্রচারিত সিরিয়াল ‘কিরণমালা’ দেখা নিয়ে দুই দলের সংঘর্ষের খবরটি শুনেই আমার মনে হল এই সংঘাত খুব অস্বাভাবিক নয়। যদি ধরেও নেই যে, ‘যুক্তিশীল’, ‘শিক্ষিত’ নাগরিকগণ কিরণমালা ধরনের সিরিয়াল দেখেন না (যা আদৌ সত্য নয়), তাহলেও কিরণমালা দেখার আগ্রহ-অভিনিবেশকে কোনোভাবেই যুক্তির কাঠামো ও শর্তে ফেলে, সরল ভালো/মন্দের ছাঁচে ফেলে বুঝতে গেলে ভুল হবে। উত্তরাঞ্চলের উপজেলা শহরে ও গ্রামের ‘অশিক্ষিত’ মানুষজন, পুরুষ-নারী-শিশু নির্বিশেষে, ভারত রাষ্ট্রের আধিপত্যের বিরোধী-নির্বিরোধী নির্বিশেষে, হিন্দু বিদ্বেষী-অবিদ্বেষী নির্বিশেষে ঘরে-বাজারের চা-এর দোকানে-বাস-অটো-রিক্সা-নসীমন-পাগলু স্টান্ডের ছোলা-মুড়ি-চায়ের টং দোকানে নিবিষ্ট মনোযোগের সঙ্গে কিরণমালা দেখেন। আমরা প্রতিরাতে এ-ঘটনা দেখেছি। বাস্তবকথা/রূপকথার ভেদরেখা অস্বীকার করে জীবনযাপন করা মানুষের জীবন- উচ্চবর্গ ও নি¤œবর্গের চৈতন্য ও সংস্কৃতির বিভাজন নস্যাত করে দিয়ে – কিরণমালার দুনিয়ার অংশীদারী হয়ে ওঠে স্বাভাবিকভাবেই।
আমরা-ওরার সম্পর্ক কখনো একদিকাভিমুখী হয় না। ফিল্ডের যাপনে আমাদের ‘যুক্তিতেই মুক্তিকামী’ মাথায় সংশয়-অবিশ্বাস উৎপাদিত হতে থাকে। তার বহিঃপ্রকাশও ঘটে যায় কখনো কখনো। যে-মানুষগুলো এই কাহিনীর দুনিয়ার বসবাস করেন, তারা আমাদের এই অন্তর্গতভাবেই স্ববিরোধী ‘যুক্তির’ দুনিয়াকে সন্দেহ করেন, আমাদেরও সন্দেহ করেন। সন্দিগ্ধতার মধ্যে আমাদের এই আধুনিক বিপন্ন বসবাস সম্ভবত কখনো এড়িয়ে যাওয়া যায় না।
একটা পর্যায়ে এসে, মাঠে কাজ করতে করতে, এই দুনিয়ার অনুষঙ্গে, সন্দেহের বদলে ঘনিষ্টতা ও পারস্পরিক চাওয়া-পাওয়ার ধরনে বদল ঘটে। কিন্তু অতীত ও বর্তমানের ওই সম্পর্কের প্রধান শর্তগুলো পাল্টায় না। এই বিষয়ে বলার চেষ্টা করব পরের কোনো একদিন।
তবে, একটা কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। ‘নিজ’ ও ‘অন্যের’ এই গতিশীল ও পরিবর্তনশীল সম্পর্কের মধ্য দিয়ে আমরা আবিষ্কার করতে থাকি ‘প্রবল’ ও ‘যুক্তিবাদী’ প্রতœতত্ত¡-ইতিহাস-প্রতœতত্তে¡র আখ্যানের সার্বজনীনীকরণের মাধ্যমে একত্বতে পৌঁছানোর সর্বগ্রাসী প্রবণতাকে। এই প্রবণতা জনস্মৃতির ও শ্রæতির স্থিতিস্থাপকতা ও বহুত্বকেও সমরূপ করে দেয় ওই আখ্যানের ছাঁচে ফেলে। বহুত্বের উদযাপনে মুখর জনশ্রুতির এই কাঠামোটি সার্বভৌমভাবেই আমাদের বর্তমানের বিদ্বেষপূর্ণ সহিংস দুনিয়ায় স্বপ্ন দেখার দারুণ এক অনুপ্রেরণা হয়ে উঠতে পারে। আপাতত, বহুত্বকে (উদ)যাপনকারী সেই স্বপ্নের ও আশার দুনিয়ায় সকলকে স্বাগত জানাই।
পাঠসূত্র:
১. আশীষ নন্দী, হিস্টোরিস ফরগটেন ডবলস। হিস্টোরি এন্ড থিয়োরি, ৩৪(২), ১৯৯৫। আরো বিশ্লেষণের জন্য পড়– https://www.academia.edu/344071/
Prachinattwa_Sabhyata_Samprity_aar_pratna_sampader_Janya_Byakul_Basona_Bangladeshe_Pratnatattwer_Adhipatyashil_Dharona_o_Anushilan_Aspiration_for_Oldness_Civilization_Communal_Harmony_and_archaeological_resources_Dominating_concepts_and_practice_of_archaeology_in_Bangladesh_
Prachinattwa_Sabhyata_Samprity_aar_pratna_sampader_Janya_Byakul_Basona_Bangladeshe_Pratnatattwer_Adhipatyashil_Dharona_o_Anushilan_Aspiration_for_Oldness_Civilization_Communal_Harmony_and_archaeological_resources_Dominating_concepts_and_practice_of_archaeology_in_Bangladesh_
..
১৩, ব্যাচেলরস কোয়ার্টার; ২০ আগস্ট, ২০১৬