[এই লেখাটি রচিত হয়েছিল ২০১৫ সালে একটি লিটল ম্যাগাজিনের জন্য। ফেসবুকে নোট হিসেবে দিয়েছিলাম। এখন আর ওই নোট পড়া সম্ভব না। তাই আবারো আমার ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে দিলাম। সঙ্কলন করা ও আগ্রহীদের জন্য পাঠযোগ্য করার লক্ষ্যে। ২০১৫ সালের পরে দিনাজপুরের অন্যত্র আমাদের দলের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা সম্প্রসারিত হয়েছে। দিনাজপুর জেলার সকল উপজেলায় সামগ্রিক নিবিড় জরিপ আমরা সম্পন্ন করেছি। আমাদের গবেষণার ফলাফলের কিছু কিছু অংশ ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। আরো প্রকাশের অপেক্ষায়।]
বর্তমান দিনাজপুর জেলা একটি সাম্প্রতিক প্রশাসনিক একক। অতীতে গেলে দেখা যায়, আজকের দিনাজপুর জেলা যে-অঞ্চলে অবস্থিত, সেই অঞ্চল খ্রি. ৯ম শতাব্দিতে বরেন্দ্র বা বরেন্দ্রী নামে পরিচিত ছিল। যা জানা যায় দক্ষিণ ভারতে পাওয়া একটি শিলালিপি মাধ্যমে। বর্তমান বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাংশ আর ভারতের পশ্চিম বাংলার উত্তর বঙ্গের মালদহ, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা মিলে গঠিত ছিল বরেন্দ্র। নবম শতকের আগেও এই অঞ্চল বরেন্দ্র বা গৌড় বা পুণ্ড্র নামে পরিচিত ছিল। বিভিন্ন তাম্রলিপিতে পাল রাজাদের ‘গৌড়েশ্বর’, ‘গৌড়াধীপ’, ‘গৌড়নৃপ’ ইত্যাদি পদাবলী ব্যবহার করে পরিচয় দেয়া থেকে ধারণা করা যায় যে, গৌড় নামে এই অঞ্চলের পরিচিতি দীর্ঘদিন ধরেই প্রচলিত ছিল।১
খ্রি. ষষ্ঠ শতক থেকে ত্রয়োদশ পর্যন্ত সময়কাল প্রত্নতাত্ত্বিক-ঐতিহাসিকদের কাছে ‘আদি মধ্যযুগ’ নামে সমধিক পরিচিত ও জনপ্রিয়, যদিও একই সময়কাল বা কালপর্বকে অন্য নামে (যেমন: মধ্যযুগ) চিহ্নিত করার উদাহরণও রয়েছে।২ দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ঐতিহাসিক উপিন্দার সিং সম্প্রতি আদি মধ্যযুগ নিয়ে সম্পাদিত একটি বইয়ের ভূমিকায় বলেছেন যে, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ইতিহাস লেখার ক্ষেত্রে আদি মধ্যযুগ সমধিক গুরুত্ব পেলেও, দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে এই সময়কালের সংহত একটি ইতিহাস এখনো তৈরি হয় নাই। আদি মধ্য যুগের আরম্ভ ও সমাপ্তি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। কোন কোন মানদন্ডেরর উপরে নির্ভর করে ওই সময়কালকে আদি মধ্যযুগ বলা হবে, তার শুরু ও শেষ নির্ধারিত হবে সেটা একটা বিস্তৃত ঐতিহাসিক বিতর্কের বিষয়। সাধারণভাবে, রাজবংশীয় ইতিহাসের দিক থেকে গুপ্ত শাসনামলের শেষ হওয়ার পরে বৃহৎ কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তে অসংখ্য ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র রাজত্বে বিভক্ত হওয়াটা একটা মানদ-। অন্যদিকে, তুর্কী৩ শাসকদের শাসনামলের শুরুকে আদি মধ্যযুগের শেষ বলে চিহ্নিত করা হয়। তবে মনে রাখা প্রয়োজন যে, শাসকদের পরিচয় নির্ভর কালপর্বজ্ঞাপক যে-কোনো পদাবলিই সমস্যাজনক, কারণ শাসক বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে কোনো জনগোষ্ঠীর যাপিত জীবন পাল্টে যায় না। তবে আদি মধ্যযুগের সমাজ-অর্থনীতি-সংস্কৃতি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক দীর্ঘ দিন যাবত চলমান। এই তর্ক-বিতর্ক প্রসঙ্গে সংক্ষেপে কিছু আলাপ করা দরকার।
মোটাদাগে বলা যায় আদি মধ্যযুগীয় দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ ও অর্থনীতি নিয়ে তিনটি তত্ত্ব রয়েছে। তত্ত্বগুলো অনড় ও অপরিবর্তনীয় কতগুলো ধারণা নয়; গত চার দশকে এই তত্ত্বগুলো যেমন রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গিয়েছে, তেমনি তত্ত্বগুলোর বিভিন্ন প্রবনতা সমন্বিতও হয়েছে। তিনটি তত্ত্ব নিয়েই বিশদ আলোচনা করা এই লেখায় সম্ভব নয়। প্রথমটির প্রবর্তক অধ্যাপক রামশরণ শর্মা। তার তত্ত্বায়িত সামন্তবাদী মডেল একটা সময় পর্যন্ত সবচাইতে প্রভাবশালী মডেল ছিল। ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক সুত্রের ব্যবহার করে তিনি ও তার অনুসারীগণ দেখান যে, গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পরে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও অর্থনীতিতে ক্রমিক অবনমন ঘটেছিল। কৃষিনির্ভর অর্থনীতির ও উৎপাদন ব্যবস্থার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে অনড়, স্বনির্ভর ও সার্বভৌম গ্রামভিত্তিক সমাজ ও বসতির উত্থান ঘটেছিল। বর্হিদেশীয় বাণিজ্যের সংকোচন ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিলোপ ঘটায় গ্রামনির্ভর অর্থনীতি বছরের পর বছর প্রচলিত ছিল। অন্যদিকে, তারা দেখান যে, নগরগুলোর অবক্ষয় ও বিলোপ ঘটেছিল। মুদ্রানির্ভর অর্থনীতি বিলুপ্ত হয়েছিল। সমাজে জাতিবর্ণ প্রথার ও ব্রাহ্মণ্যবাদের ক্রমপ্রসার ঘটছিল সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে। বৃহৎ ও কেন্দ্রশাসিত রাষ্ট্রের স্থানে অসংখ্য ছোট ছোট আঞ্চলিক রাষ্ট্রের উত্থান ঘটেছিল আর এই রাষ্ট্রগুলো কেবল রাজা নয়, পাশাপাশি সামন্তপ্রভুদের কতৃত্ত্ব দ্বারাও পরিচালিত হত। ১৯৫০-এর দশকে প্রবর্তিত সামন্ততান্ত্রিক মডেল পরবর্তীতে ১৯৭০-এর দশকে ব্যপক সমালোচনার মুখে পড়ে। রামশরণ শর্মা ও তার অনুসারীগণ তাদের প্রবর্তিত প্রাথমিক তত্ত্বায়নে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনও আনেন পরবর্তীতে।৪
একদিকে অধ্যাপক বারটন স্টেইন প্রবর্তন করেন সেগমেনটারি রাষ্ট্র প্রচলিত হওয়ার তত্ত্ব।৫ অন্যদিকে, অধ্যাপক ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় প্রবর্তন করেন অন্তর্ভুক্তি মূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রক্রিয়াবাদী মডেল। পরবর্তীতে এই ধারণার সম্প্রসারণ ঘটান অধ্যাপক হারমান কুলকে।৬ এই তত্ত্ব অনুসারে আদি মধ্যযুগে যেমন অসংখ্য আঞ্চলিক রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে তেমনই এই রাষ্ট্রগুলো নতুন নতুন জনপদ ও জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রের আওতায় নিয়ে আসে। সামন্তবাদী মডেলে বর্ণিত একধরনের অনড়, অপরিবর্তনশীল ও সার্বভৌম গ্রামভিত্তিক সমাজের ও অর্থনীতির পরিবর্তে এই মডেল প্রস্তাব করে যে, গতিশীল ও পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত উৎপাদন ও বাণিজ্য নির্ভর বসতির প্রবর্তন ঘটে এই সময়ে। ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় স্পষ্টভাবেই দেখান যে, কোনো কোনো নগরকেন্দ্রের অবক্ষয় ও অবলুপ্তি ঘটলেও নতুন নতুন নগরকেন্দ্রের উত্থান ঘটেছিল।৭ পূর্ববর্তী সময়ে নগরকেন্দ্রগুলোর উত্থানে বা নগরায়নের বিকাশে যেমন বহির্বাণিজ্যেকে প্রধান প্রভাবক মনে করা হত, তা ভুল ছিল বলে মনে করেন হালের অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক-ঐতিহাসিক। নগরায়নের এই পর্বকে তৃতীয় পর্যায়ের নগরায়ন বলে চিহ্নি করেন ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়। কৃষিভিত্তিক উৎপাদন ও বসতির বিকাশের পাশাপাশি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে এবং তিব্বতসহ চিনের সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগের বিকাশ ঘটছে এই কালপর্বে। বিভিন্ন অঞ্চলে ভক্তিবাদী মতের বিকাশের কারণে বৌদ্ধ ধর্ম বিলীয়মান হয়ে পড়ছিল। সমকালীন বজ্রযান ও তন্ত্রযান বৌদ্ধমতাবলম্বী সম্প্রদায়গুলোর শক্তিশালী উপস্থিতি শেষ পর্যন্ত ছিল পূর্ব ভারতে। তবে সেই উপস্থিতিও ব্রাহ্মণ্যবাদী বিভিন্ন মত ও সম্প্রদায়ের সম্প্রসারনের কারণে প্রান্তিক হয়ে উঠছিল। বিভিন্ন মত ও পথের সম্প্রদায়গুলোর মধ্যকার সম্পর্ক এই সময়ে খুবই গতিশীল ও দ্বাদ্বিক ছিল। কেবল সংঘাত কিংবা কেবল সমন্বয়ের কোনো সরলরৈখিক ইতিহাস দিয়ে এই সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে যাওয়া ভুল হবে। একটা উদাহরণ দিতে পারি। এই সময়ে বাংলা অঞ্চলের পুরাণগুলো নিয়ে কুনাল চক্রবর্তীর গবেষণায় দেখা যায়, লোকধর্মগুলো আর লোকায়ত দেব ও দেবীগণ মূলধারার ব্রাহ্মণ্যধর্মের মধ্যে আত্তীকৃত হয়েছিল। উদাহরণ হিসাবে দেবীমাহাত্মের কথা বলা যায়, যেখানে দেবীর নানান রূপের কথা বলা হয়েছে। তিনি দেখান যে, মূলধারার ব্রাহ্মণ্যবাদী পৌরানিক ভক্তি মতগুলোর প্রভাববিস্তারের আগেই বাংলা অঞ্চলে স্বয়ংশাসিত দেবী উপাসনার রীতি ছিল। এই লোকায়ত দেবীরূপগুলো পরবর্তীতে ব্রাহ্মণ্য মতে আত্তীকৃত হয়। দেবীর বিভিন্ন রূপ যেখানে আগে স্বতন্ত্রভাবে উপাসিত হত, পরবর্তীকালীর পুরাণগুলোতে তাদের শিবের সঙ্গিনী হিসাবে দেখানো হতে থাকে। এভাবে এখানে শৈব ও শাক্ত উপাসনা মতের সমন্বয় ঘটে।৮ আবার, বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য মতগুলোর প্রতিনিধিত্বকারী উপাসিত বিভিন্ন পদপিষ্টকারী দেব-দেবীর (যেমন : বৌদ্ধ দেবতা ত্রৈলোক্যবিজয় বা দেবী পর্ণশর্বরী বা শাক্ত ধারার চামুণ্ডার প্রতীমায়/মূর্তির একটি রূপে দেখা যায় ভিন্ন ধর্মমতাবলম্বীদের উপাস্য দেবতা বা দেবীকে উক্ত দেবতা বা দেবী পদপিষ্ট করছেন বা পায়ের নিচে উপস্থাপিত হচ্ছে) প্রতীমা থেকে অনুমান করা যায় যে, নিজ সম্প্রদায়ের উপাস্য দেব-দেবীকে অন্য সম্প্রদায়ের দেব-দেবীর তুলনায় শক্তিশালী ও শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার জন্য এমন প্রতীমা চিত্রন করা হয়েছে। একাদশ-দ্বাদশ শতকের আগের কোনো এক সময়ে সোমপুর মহাবিহারে বঙ্গাল দেশীয় সৈন্যদের আক্রমণ ও ধ্বংসযজ্ঞের উল্লেখ পাওয়া যায় নালন্দা থেকে পাওয়া একটি তাম্রলিপিতে। এ-অবস্থা বিভিন্ন মতের মধ্যকার ধর্মীয় বা রাজনৈতিক সংঘাতময়তার স্বাক্ষর। আদি মধ্যযুগ নিয়ে লিখিত ও প্রকাশিত বিপুল গবেষণারাশির সঙ্গে তুলনা করলে উপর্যুক্ত আলোচনা অতি সংক্ষিপ্ত ও সরলীকৃত। কিন্তু বরেন্দ্র এলাকার মানব বসতির ধরন বোঝার ও ব্যাখ্যা করার জন্য বর্তমান পরিসরে এই আলোচনা আমলে আনা জরুরি। এর কারণ বিবিধ।
লিখিত উৎস ও লিপিগত উপাত্ত ব্যবহার করেই আদি মধ্যযুগীয় ইতিহাস আর ইতিহাসের নানাবিধ ও প্রতিরুদ্ধ আখ্যান তৈরি হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের ব্যবহার এই ইতিহাস লিখনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সীমিত। এর একটি কারণ হল, দক্ষিণ এশিয়ায় আদি মধ্যযুগীয় প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে পরিচালিত গবেষণার পরিমানগত ও গুণগত সীমাবদ্ধতা। হরপ্পা সভ্যতা সংশ্লিষ্ট প্রত্নতত্ত্ব চর্চা, প্রাগিতিহাসিক প্রত্নতত্ত্ব চর্চা ও আদি ঐতিহাসিক যুগীয় প্রত্নতত্ত্ব চর্চার দীর্ঘ দিনের ঐতিহ্য ও ব্যাপ্তি, পদ্ধতিগত রূপান্তর ‘আদি মধ্যযুগের’ তুলনায় অনেক বেশি দৃশ্যমান ও শনাক্তযোগ্য। আরেকটি কারণ হল, ইতিহাস লিখনের পদ্ধতিতে লিখিত ও লিপিগত উৎসের ব্যাখ্যা থেকে উদ্ভুত বিভিন্ন সিদ্ধান্তের সমর্থনের উদ্দেশ্যেই প্রধানত প্রত্নতাত্ত্বিক উৎসের ব্যবহার হয়েছে। অন্য আরেকটি গুরুতর কারণ নিহিত ‘আদি মধ্যযুগ’ সংশ্লিষ্ট প্রত্নস্থান নির্বাচনে ও প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা পরিচালনার পদ্ধতিতে। প্রধানত, বৃহৎ, দৃশ্যমান ও নগরকেন্দ্র হিসাবে পরিচিত প্রত্নস্থানগুলো প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার জন্য বাছাই করা হয়েছে। আর, পরিচালিত খনন ইতোমধ্যে পুরানো হয়ে যাওয়া হুইলারীয় পদ্ধতি ও এর নানান স্থানীয় সংস্করণের মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয়েছে। এসব খননের প্রতিবেদনের বেশিরভাগই অসম্পূর্ণ। ফলত যে-সব প্রত্নতাত্ত্বিক উপাত্ত আদি মধ্যযুগীয় সময়কাল ব্যাখ্যা করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলো পদ্ধতিগত ভাবেই ত্রুটিপূর্ণ ও পক্ষপাতদুষ্ট। যেমন, সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রবন্ধে জেসন হকস দেখিয়েছেন যে, আদি ঐতিহাসিক যুগে নগরবসতি হিসাবে গড়ে ওঠা অনেক প্রত্নস্থানেই প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে কোনো আদি মধ্যযুগীয় বসতির চিহ্ন পাওয়া যায় নাই বলে খনন প্রতিবেদনে উল্লিখিত হয়েছে।৯ কিন্তু ওই খনন প্রতিবেদনগুলোর ভিন্নপাঠে বোঝা যায় যে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটি স্থানে বসতি গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে যে স্থানিক ভিন্নতা তৈরি হতে পারে তা খননের উপাত্তের ব্যাখ্যায় আদৌ আমলে নেয়া হয় নাই। ফলে একটি বৃহৎ আয়তনের প্রত্নক্ষেত্রের নির্দিষ্ট ও নির্বাচিত কয়েকটি স্থানে পরিচালিত খননের ভিত্তিতে যখন বলা হয় ওই প্রত্নস্থানে আদি ঐতিহাসিকসহ আদি মধ্যযুগ পূর্ববর্তী বসতির বা নগরবসতির চিহ্ন স্পষ্ট হলেও, আদি মধ্যযুগের বসতির চিহ্ন অস্পষ্ট বা অনুপস্থিত বা নগরায়নের ধারাবাহিকতা প্রতিপাদনে অক্ষম, তখন এই পদ্ধতিগত ত্রুটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এছাড়াও, অনুভূমিকভাবে খননের পদ্ধতি প্রয়োগ করে সাম্প্রতিককালের স্তরবিন্যাসবিদ্যাগত কৌশল ও বিশ্লেষণী পরিকাঠামো ব্যবহার না করায়, কালানুক্রমিক ও স্থানিক ভাবে বসতির প্রকৃতি, ধারাবাহিকতা ও রূপান্তর চিহ্নিত করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
প্রত্নতাত্ত্বিক উৎসকে লিখিত ও লিপিগত উপাদান থেকে স্বতন্ত্র ভাবে ব্যাখ্যা করতে হয়। পদ্ধতিগত এই ভিন্নতার কথা বলার অর্থ এই নয় যে, আমি লিখিত ও লিপিগত উৎসকে খারিজ করে দিচ্ছি বা প্রত্নতাত্ত্বিক উৎস লিখিত ও লিপিগত উৎসের তুলনায় অধিকতর নির্ভরযোগ্য বলে দাবি করছি। ব্যাখ্যার সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা সকল ধরনের উৎস ও উপাদানের জন্যই প্রযোজ্য। সাবেজেকটিভিটির প্রপঞ্চ বিবেচনায় নিলে ‘বস্তুনিষ্ঠতা’ ও ‘নিরপেক্ষ’ ব্যাখ্যার ধারণা সবসময়ই বিপজ্জনক। তবে, প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়া ঐতিহাসিক আখ্যানে যেহেতু প্রত্নতাত্ত্বিক উপাত্তের ব্যবহার সীমিত এবং যে সকল ক্ষেত্রে এই উপাদান ব্যবহার করা হচ্ছে সেক্ষেত্রে উপাত্তগুলোর উদ্ধারে ও ব্যাখ্যায় পদ্ধতিগত ভ্রান্তি ও ত্রুটি থেকে গেছে, সেহেতু ওই ঐতিহাসিক আখ্যানের মূল্যায়নে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎস নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।
প্রত্নতাত্ত্বিক উপাত্ত বলতে এখানে আমি কী বোঝাচ্ছি সেটা একটু ব্যাখ্যা করাও জরুরি। আমাদের দেশে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাত্ত বলতে সাধারণত বোঝা হয় সেইসব নিদর্শন যেগুলো ‘মূল্যবান’, ‘প্রদর্শনযোগ্য’ বা সহজে ‘সমৃদ্ধ অতীত’ পরিবেশন করার উপযোগী। কিছু কিছু প্রত্নস্থাপনা, যেমন: বড় আকারের স্থাপত্য, ভাস্কর্য, মুদ্রা, দামি ও বিশেষ ধরনের মৃৎপাত্র, গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয় এমন ধাতব বস্তু ইত্যাদি। প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বা খনন করার সময়ও এই ধরনের নিদর্শনই উদ্ধার করা হয় এবং পরে নির্বাচিতভাবে জাদুঘরগুলোতে প্রদর্শন করা হয়। প্রত্নতত্ত্ব চর্চার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, নগরকেন্দ্রগুলো বা নগরকেন্দ্রীক বসতি হিসেবে চিহ্নিত প্রত্নস্থানগুলো সমধিক গুরুত্ব পেয়ে আসছে। উত্তর ভারতের নগর-বসতিগুলোর সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজে আমরা প্রাকারবেষ্টীত (ইটের বা মাটির প্রাচীর) যে-কোনো প্রত্নস্থানকেই নগরকেন্দ্র হিসাবে চিহ্নিত করে আসছি। অথচ কোনো স্থান প্রাচীর/প্রাকারবেষ্টীত হওয়ার অর্থ এই নয় যে সেটা নগর হবে। ‘সমৃদ্ধ’, ‘উন্নত’, ‘দ্বন্দ্ববিহিন’, ‘সভ্য’ একটি অতীত উপস্থাপন করার সরলিকৃত একটি বয়ান এই চর্চা থেকে তৈরি হয়। যে চর্চা ঔপনিবেশিক ও জাতীয়তাবাদী চর্চা ও বাসনা থেকে উদ্ভূত তারই একটি উদাহরণ হল এমন ‘নগরকেন্দ্রীক’বা ‘মূল্যবান নিদর্শনকেন্দ্রীক’ প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাস চর্চা। তবে এ-কথা বলার অর্থ এই নয় যে, নগরকেন্দ্রীক প্রত্নতত্ত্ব চর্চা পরিত্যাজ্য। বরং সুপরিকল্পিতভাবে গবেষণা করার মধ্য দিয়ে একটি নগর ও তার চারপাশের হিন্টারল্যান্ড এলাকার বসতির প্রকৃতি ও পরিবর্তন সম্পর্কে বিশদ ও ধারণা পাওয়া যায়। এর প্রমাণ বাংলাদেশের মহাস্থানগড়ে পরিচালিত বাংলাদেশ-ফ্রান্স যৌথ দলের খননের প্রতিবেদন যেটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে।
আদি মধ্যযুগের সমাজের, ধর্মের ও অর্থনীতির যে জটিল ইতিহাস আমাদের সামনে ইতোমধ্যে হাজির আছে সেই ইতিহাসকে নিরিখ করার জন্য আদি মধ্যযুগের নতুন ধরনের প্রত্নতত্ত্ব চর্চা প্রয়োজন। প্রথমত, এই প্রত্নতত্ত্ব চর্চায় কোনো বিশেষ ধরনের বা প্রকৃতির প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান ও নিদর্শনের প্রতি পক্ষপাত থাকবে না; দ্বিতীয়ত, প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ পরিচালনা করতে হবে কেবল কতগুলো প্রধান বা গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে অনুমিত প্রত্নস্থান নথিভুক্ত করার উদ্দেশ্য নিয়ে নয়; বরং অতীত মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত সকল ধরনের আলামত ও প্রমাণ শনাক্ত করে সেগুলো বিভিন্ন পদ্ধতিতে নথিভুক্ত করতে হবে যাতে করে নথিভুক্ত উপাত্তকে জিআইএস – পরিপ্রেক্ষিতে রেখে বিশ্লেষণ করা যায়। তৃতীয়ত, প্রত্নস্থানগুলো কী-ভাবে কোন স্থানে অবস্থিত ও বিস্তৃত তা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করতে হবে। চতুর্থত, পুরানো পুকুর ও দীঘির মত প্রত্নতাত্ত্বিক আলামতগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে সেগুলোর সঙ্গে প্রত্নস্থানগুলোর সম্পর্ক বোঝার চেষ্টা করতে হবে। পঞ্চমত, প্রত্নতাত্ত্বিক খননের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ভূমিরূপে অবস্থিত বিভিন্ন ধরনের প্রত্নস্থান নির্বাচন করতে হবে। ষষ্ঠত, খননের উদ্দেশ্য কেবল প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের উদ্ধার হলে হবে না; পুরানো দেয়াল ও স্থাপত্যকাঠামো উন্মোচন করা হলে হবে না। বরং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানবীয় ও পরিবেশগত ঘটনার কারণে ও প্রভাবে একটি স্থাপনা ও তার চারপাশের স্থানে যে পরিবর্তনগুলো হয় বা শতকের পর শতক যে ধারাবাহিকতা থাকে সেই পরিবর্তন ও ধারাবাহিকতাকে এবং তার কারণকে শনাক্ত করতে চেষ্টা করতে হবে। একটি স্থাপনার কয়টি নির্মাণপর্ব (কতবার সেই স্থাপনাটি সংস্কার হয়েছে, পুনর্নিমিত হয়েছে বা পরিবর্ধিত হয়েছে) শনাক্ত করাই যেন প্রচলিত অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক খননের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু একটি স্থাপনার দেয়ালের উপরে তো মানুষ বসবাস করে নাই; মানুষ তার বিভিন্ন কর্মকা- পরিচালনা করে নাই। মানুষ দেয়াল দিয়ে আবদ্ধ স্থানে বসবাস করেছে এবং সেই স্থান ও দেয়াল দিয়ে ঘেরা স্থানের বাইরের স্থান বিভিন্ন কাজে (যেমন: ব্যবহারের অযোগ্য মৃৎপাত্র ফেলার কাজে, বর্জ্য ফেলার কাজে, ইত্যাদি) ব্যবহার করেছে। বিভিন্ন সময়ে এই ব্যবহারের ধরন পাল্টেছে বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও মানবীয় প্রক্রিয়ার কারণে। খননের সাম্প্রতিকতম পদ্ধতি প্রয়োগ করলে, নথিভুক্ত করলে ও ব্যাখ্যা করলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত বস্তুরাজি ( যাকে আমরা বলি বস্তুসংস্কৃতি), সেগুলো কী অবস্থায় আছে, কী ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সেগুলো গেছে তা বোঝা যায়। সপ্তমত, বাংলাদেশের মত ভূমিরূপ যেখানে নদী, নদীব্যবস্থা ও নদীব্যবস্থার নিয়ত বদলে যাওয়া মানুষের জীবনযাপনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে সম্পর্কিত, সেখানে নদীর ইতিহাস না বুঝলে, নদীর বদলে যাওয়ার প্রকৃতি, অনুষঙ্গ ও ধরনকে, অর্থাৎ নদী-ভূমিরূপ-মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কেও ইতিহাস না বুঝলে আমরা যা জানতে পারব তা হবে আংশিক ও খ-িত। এই ধরনের বোঝাপড়ার মাধ্যমেই অতীত মানুষের ( কোনো রাজার নয় বা কোনো নগরের নয়) জীবনযাপন, তৎকালীন সমাজ ও রাজনীতি সম্পর্কে নির্মোহ অনুমান করা সম্ভব। এজন্যই উপর্যোক্ত বিষয়গুলো মনে রেখে মানুষের বিভিন্ন ধরনের বসতিগুলোকে শনাক্ত করা যায়, সেই বসতিগুলোর পরিবর্তন ও রূপান্তর বোঝা যায়, বসতিগুলোর প্রেক্ষিতে রেখে এবং বসতিগুলোর আন্তঃসম্পর্কের প্রেক্ষিতে রেখে সাধারণ মানুষের জীবনকে বোঝা সম্ভব হতে পারে। আদি মধ্যযুগের সামাজিক প্রেক্ষিতকে বুঝতে গেলে বসতি ও বসতি বিন্যাস প্রত্নতত্ত্বের বিকল্প নাই। মনে রাখা প্রয়োজন যে, প্রত্নতত্ত্বে বা ইতিহাসে শতকরা একশত ভাগ নিশ্চয়তা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না।

আদি মধ্যযুগীয় প্রত্নতত্ত্ব চর্চার উপরের প্রসঙ্গগুলো মনে রেখে আমরা বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে গত পনের বছর ধরে গবেষণা করে আসছি। সময়সাপেক্ষ হওয়ায় ও আর্থিক সঙ্গতি না থাকায়, আমরা দিনাজপুর ও জয়পুরহাট জেলায় আমাদের গবেষণা এখনো সীমাবদ্ধ রেখেছি। অতীতে বরেন্দ্র এবং গৌড় নামে পরিচিত এই এলাকা সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়ার কিছু নমুনা সংক্ষেপে ও তুলনামূলক সরলভাবে নিচে উল্লেখ করার চেষ্টা করলাম। তবে এই অনুমানগুলোকে কোনোভাবেই আদি মধ্যযুগীয় বরেন্দ্র বা গৌড়ের সমাজ ও পরিবেশকে বোঝার জন্য সাধারণীকরণ করে প্রয়োগ করলে হবে না। কারণ সেই গৌড় বা বরেন্দ্রের আয়তনের তুলনায় অল্প এলাকাই আমরা এখন পর্যন্ত গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছি:
এক. এই অঞ্চলে বসতিগুলো প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান, কৃত্রিম জলাশয় (পুকুর/দীঘি) ও বিশেষকরে ফেলে দেওয়া বা পরিত্যক্ত মৃৎপাত্রের টুকরোর বিস্তৃতির মাধ্যমে চিহ্নিত করা যায়। এগুলো গুচ্ছাকারে বা বিচ্ছিন্নভাবে ভূপৃষ্ঠের উপরে ছড়িয়ে আছে। দিনাজপুর জেলার বিরামপুর, ফুলবাড়ি, হাকিমপুর, নবাবগঞ্জ আর জয়পুরহাট উপজেলার পাঁচবিবি, কালাই ও ক্ষেতলাল উপজেলায় আমরা ৬৬ টি বিভিন্ন আকারের ও আয়তনের আদি মধ্যযুগীয় মানব বসতি শনাক্ত করেছি। এছাড়াও, ১০৪ টি বিচ্ছিন্ন প্রত্নস্থান রয়েছে যেগুলো বসতির বাইরে ছিল বা প্রান্তে ছিল।
দুই. যে প্রত্নস্থানগুলো আমরা পেয়েছি সেগুলোর একটা শ্রেণী হল স্থাপত্যকাঠামোবিশিষ্ট ঢিবি। এগুলো প্রধানত ধর্মীয় বিভিন্ন স্থাপনা, যেমন বৌদ্ধ বিহার, বৌদ্ধ বা হিন্দু মন্দির, বৌদ্ধ স্তূপ ইত্যাদির ধ্বংসাবশেষকে ধারণ করছে। আদি মধ্যযুগীয় মানব বসতিগুলো এই ধর্মীয় স্থাপনাগুলো কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল। এই মানব বসতির কোনোটিই নগর ছিল না। কোনো কোনোটির আকার মহাস্থানগড় (তৎকালীর পু-্রনগর) ও বানগড়ের (তৎকালীন কোটিবর্ষ) চাইতেও প্রায় দুই বা তিনগুণ বড়।
তিন. মানব বসতিগুলো মূলত গ্রাম বা সম্পন্ন বৃহৎ আকারের গ্রাম বা গ্রাম ও নগরের মাঝামাঝি অবস্থার বসতি। এগুলো কোনোভাবেই একটি থেকে অন্যটি বিচ্ছিন্ন ছিল না; বরং এগুলো ব্যবহারের ও পরিবর্তনের ধরন ও কালানুক্রম পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, একটির সঙ্গে আরেকটির গতিশীল সম্পর্ক ছিল।
চার. বসতিগুলোর স্থানিক বিস্তৃতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কোথাও কোথাও খুব পাশাপাশি একটা বিস্তৃত এলাকাজুড়ে এগুলো বিস্তৃত। যেমন: বর্তমান বিরামপুর-নবাবগঞ্জে নলশীশা-আশুলি-ছোট যমুনা নদীর পাড় ধরে প্রায় ২০ কি.মি. এলাকাজুড়ে খুব ঘনসন্নিবিষ্ট বসতির বিস্তার ঘটেছিল। আমরা অনুমান করি, বসতির নেটওয়ার্কে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল/নোডাল জোন ছিল।
পাঁচ. বসতিগুলো লালাভ হলুদাভ বা লালাভ বাদামী রংয়ের মাটি বিশিষ্ট বরেন্দ্রভূমির মাটিতে যেমন অবস্থিত, ঠিক তেমনি নিয়মিত প্লাবিত হয় এমন সমতলভূমিতেও অবস্থিত। নদীর ধার ঘেষে রৈখিক ভাবে এগুলো যেমন বিস্তৃত, তেমনই বৃত্তাকারে ঘনসংবদ্ধ আকারে এগুলো বিস্তৃত। এই বিস্তৃতির কারণ যেমন নদীর অবস্থান, তেমনই চাষযোগ্য সমতল ভূমির অবস্থান।
ছয়. বসতিগুলোর সমসাময়িক কৃত্রিম জলাশয়গুলো বসতির কাছে যেমন অবস্থিত, ঠিক তেমনি বসতি থেকে দুরে বিচ্ছিন্নভাবে বা গুচ্ছাকারে অবস্থিত। বসতির নিকটবর্তী জলাশয়গুলো দৈনন্দিন গৃহস্থালী কাজে বা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের কাজে ব্যবহৃত হত। অন্যদিকে, দুরে জলাশয়গুলো বর্ষাও পানি সঞ্চিত করে শীতকালে সেচের কাজে ব্যবহৃত হত। উঁচু, লালাভ বাদামী মৃত্তিকা বিশিষ্ট জমির তুলনায় সমতলভূমিতে এই জলাশয়ের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কম। তার কারণ এই ধরনের জমিতে জল সঞ্চিত করে সেচের প্রয়োজনীয়তা কম ছিল।
সাত. জরিপ ও খননের উপাত্তের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে আমার দেখতে পেয়েছি যে, খ্রি.৭ম-৮ম শতকের দিকে এখানে আকশ্মিকভাবে বসতির সংখ্যা অনেক বেড়ে গিয়েছিল পূর্বের সময়ের তুলনায়। বসতির বেড়ে যাওয়া স্বাভাবিকভাবেই জনসংখ্যার বেড়ে যাওয়াকে নির্দেশ করে, নতুন নতুন জমি আবাদের উপযোগীকরণের প্রমাণ বহন করে, ক্রমশ জটিল হয়ে ওঠা সামাজিক স্তরবিন্যাস ও জটিলতাকে নির্দেশ করে। আদি মধ্যযুগের সমাজ সম্পর্কিত ইতিহাসের সামন্ততান্ত্রিক মডেল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র বিস্তারের মডেলের তত্ত্বের বেশ কিছু ব্যাখ্যার সঙ্গে এই আলামত সামঞ্জস্য বিধান করে।
আট. প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসে খ্রি. ৭ম-৮ম শতকের আগে এই এলাকায় মানব বসতির বিস্তৃতির কথা উল্লেখ করা হয়। বিশেষকরে, লিপিগত ও লিখিত উৎসের ভিত্তিতে বলা হয়ে থাকে গুপ্ত শাসনামলে ও পরবর্তীতে এই এলাকার মানব বসতির সম্প্রসারণ ঘটেছিল। কিন্তু মহাস্থানগড় ও বানগড় ছাড়া (এই দুটি স্থানে খনন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বলা যায়) আমাদের জরিপ ও খননকৃত কোনো স্থান থেকে আমরা ৭ম-৮ম শতক পূর্ববর্তী কোনো আলামত পাই নাই। এক্ষেত্রে লিপিগত ও লিখিত উৎসের উপাত্তের সঙ্গে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাত্তের বৈসাদৃশ্য তৈরি হয়। আমরা অনুমান করি, গুপ্ত শাসনামল ও তার পরবর্তী সময়ে এই এলাকায় মানব বসতির যে ব্যপক বিস্তৃতির কথা বলা হয় তা সঠিক নয়। তবে অবশ্যই ওই সময়ে এখানে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ক্ষুদ্র পরিসরের মানব বসতি গড়ে উঠেছিল। সেই মানববসতিগুলোর প্রমাণ বা আলামত বিভিন্ন প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় আর পরবর্তীকালীন বসতি গড়ে ওঠার প্রবল তৎপরতার কারণে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
নয়. খননের উপাত্তের কালানুক্রমিক ও স্তরবিন্যাসগত ব্যাখ্যায় আমরা লক্ষ করেছি যে, কোনো কোনো বসতিতে ধারবাহিকভাবে মানুষ থেকেছে খ্রি. ১৪শ – ১৫ শ শতক পর্যন্ত। কিন্তু এক্ষেত্রে বসতির প্রকৃতি ও কাঠামো পরিবর্তিত হয়েছে। কোনো মন্দির পরবর্তীতে সেক্যুলার বসতি হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে; কোনো বৌদ্ধ বিহার পরে ভিন্ন কোনো সেক্যুলার কাজে, মানুষের বসবাসের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে; কোনো বৌদ্ধ স্তূপ রূপান্তরিত হয়েছে হিন্দু মন্দিরে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যাওয়া সামাজিক ও ধর্মীয় পরিপ্রেক্ষিত এই রূপান্তরে কার্যকর প্রভাবক হিসাবে কাজ করেছে।
দশ. একটি মন্দিরও তার রূপ পাল্টেছে। যেমন: বিরামপুরের চ-ীপুরে আমরা একটি বিষ্ণু মন্দির পেয়েছি। সেই মন্দিরটির গর্ভগৃহ খ্রি. আনু. ১০ম-১১শ শতকের দিকে ভেঙে ফেলা হয়। আমরা অনুমান করি, এটি কোনো সম্প্রদায়গত সংঘাতে বা কর্তৃত্ব বিস্তারের জন্য ঘটা সংঘাতে ধ্বংস হয়েছিল। পরবর্তীতে ওই মন্দিরটির গর্ভগৃহ পুনর্গঠিত হয় এবং ম-ব পরিত্যক্ত হয়। কিন্তু মন্দির হিসাবে এর ব্যবহার অব্যহত থাকে। কিন্তু খ্রি. ১৪শ শতকের দিকে এটি সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হয় প্রধানত স্থানীয় নদীব্যবস্থার পাল্টে যাওয়ার কারণে। মন্দির ও বসতিটি বর্তমান ছোট যমুনা নদীর একটি পুরানো নদীখাতের পূর্বতীরে অবস্থিত। আবার, খ্রি. ১৬শ- ১৭শ শতকের দিকে মন্দিরটি যখন পরিত্যক্ত হয়ে ঢিবিতে রূপান্তরিত হয়েছে, তখন সেই ঢিবির উপরে এসে তৎকালীন মানুষ বসবাস করেছে এবং লৌহ নিদর্শন উৎপাদনের সঙ্গে ঢিবিটিকে সম্পর্কিত করেছে।
এগার. কোনো কোনো বসতিতে হিন্দু মন্দিরের ব্যবহার এই এলাকায় ত্রয়োদশ শতকে বখতিয়ার খলজির আগমনের পরেও অব্যহত ছিল। বিরামপুরের সন্দলপুরে একটি বৌদ্ধ স্তূপকে সম্ভবত শিব মন্দিরে রূপান্তর করা হলেও, সেই মন্দিরটি ১৪শ-১৫শ শতক পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়েছিল। মন্দিরটি আশুলি নদীর আদিখাতের পাড় ঘেষে ছিল এবং সেটি নদীর প্রবাহপথের পরিবর্তনের কারণে প্রভাবিত হয়েছিল।
বার. প্রচলিত ইতিহাসে ধরে নেয়া হয় যে, বৌদ্ধ বিহারগুলো তৎকালীন জনবসতি থেকে কিছুটা দুরে, বিচ্ছিন্ন হয়ে গড়ে উঠেছিল। অনুমান করে নেয়া হয় যে, বিহারে বসবাসরত বৌদ্ধ শ্রমণগণ ধর্মচর্চা ও শাস্ত্রচর্চা করতেন বলে এই বিচ্ছিন্নতা জরুরি ছিল। কিন্তু পাহাড়পুরের সোমপুর মহাবিহারে আমাদের পরিচালিত গবেষণা এবং দিনাজপুরের নবাবগঞ্জের দোমাইলে বৌদ্ধ বিহারের যে গুচ্ছ আমরা খুঁজে পেয়েছি সেটা সহ আরো কয়েকটি বসতি (যেমন: বিরামপুরের চরকাই, ফুলবাড়ীর পুকুরী কিংবা পাঁচবিবির পাথরঘাটার উচাই) বৌদ্ধ বিহার বা বিহারগুচ্ছ কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। সাঁচি, ভারহুত, অমরাবতির মত আদি-ঐতিহাসিক যুগের বৌদ্ধ বিহার ও স্তূপ কেন্দ্রীক মানব বসতির প্রমাণ সাম্প্রতিক কালে আবিষ্কৃত হওয়ায় এবং নালন্দার বৌদ্ধ বিহার সংলগ্ন মানব বসতি এবং হাটের মত বাণিজ্যকেন্দ্রের প্রমাণ পাওয়া যাওয়ায় বৌদ্ধ বিহার সম্পর্কে ধরে নেয়া স্বতঃসিদ্ধ ধারণাগুলো পাল্টে গেছে।১০ বৌদ্ধ সঙ্ঘ (যারা মহাবিহার/বিহার/বিহারিকায়) বসবাস করেন কেবল ধর্মচর্চা, শাস্ত্রচর্চা ও ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন এবং সাধারণ সমাজের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ নিতান্তই নির্ভরশীলতার ছিল বলে যে ধারণা প্রতিষ্ঠিত তা যে ভ্রান্ত তার প্রমাণ প-িতগণ দিয়েছেন। বরং লিপিগত প্রমাণে দেখা যায়, রাজাদের দানকরা নিষ্কর ভূমিদানের ফলে খ্রি. ৭ম-৮ম শতকে বৌদ্ধ বিহারগুলো বিপুল পরিমাণ ভূসম্পত্তির মালিক হয়ে উঠেছিল। এই ভূমির আবাদ ও শস্যের ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট বিহারের ভিক্ষুগণ যুক্ত থাকতেন। তৎকালীন বাণিজ্য পথের ও নেটওয়ার্কের পাশেই অনেক বৌদ্ধ বিহারগুলো গড়ে উঠেছিল। বাণিজ্য সংঘঠনেও বৌদ্ধ বিহার ও সঙ্ঘের ভূমিকা ছিল। সমসাময়িক সমাজ ও বিহারগুলোর সম্পর্ক নিবিড় ছিল, বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ সমাজের ও উৎপাদনের বিভিন্ন পরিক্ষেত্রে যুক্ত থাকতেন। সোমপুর মহাবিহারের প্রত্নতাত্ত্বিক উপাত্তের ভিত্তিতে আমার আরো ধারণা করি যে, সংলগ্ন এলাকার সেচ ও বন্যা ব্যবস্থাপনায় ওই বিহারের বৌদ্ধ সঙ্ঘের তাৎপর্যপূর্ণ অবদান ছিল। বৌদ্ধ বিহারকে আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনা করা তাই ভ্রান্ত। প্রখ্যাত প-িত ফ্রেডরিখ এ্যাশার এ-প্রসঙ্গেই নালন্দা মহাবিহার নিয়ে খুব চমৎকার আলোচনা করেছেন সম্প্রতি।১১
তের. নবাবগঞ্জের দোমাইলে যে বৌদ্ধ বিহারগুচ্ছ আমরা পেয়েছি সেই বিহারগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বসতি খ্রি. ১২শ-১৩শ শতকে পরিত্যক্ত হয়েছিল কেবল পাশ্ববর্তী নলশীশা নদী ও তুলশীগঙ্গা নদীর গতিপথের পরিবর্তনের কারণে এবং সম্পর্কিত বন্যার ফলে। অর্থাৎ বরেন্দ্র অঞ্চলে আদি মধ্যযুগে মানব বসতি গড়ে ওঠার ও বিলুপ্ত হওয়ার, বা অব্যবহতভাবে বসতি থাকার, বা পরিত্যক্ত হওয়ার পরে পুনরায় বসতি গড়ে ওঠার যে আলামতগুলো আমি উপরে হাজির করলাম তা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আদি মধ্যযুগে এই এলাকায় মানববসতি গড়ে ওঠার, রূপান্তরিত হওয়ার বা পরিত্যক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া ও কারণগুলো স্থান ও সময়ভেদে বিবিধ ছিল। কোনো সমরূপ ও সমসত্ত্ব ঐতিহাসিক রূপরেখায় ফেলে এই ইতিহাস ব্যাখ্যা করা যাবে না।
চৌদ্দ. আদি মধ্যযুগে এখানে মানব বসতির আকার ও প্রকারও বিভিন্ন ছিল। কোনোটি ছিল মাটির প্রাচীর ঘেরা। কোনোটি ছিল পরিখা ঘেরা। কোনোটি অসংখ্য পুকুর দিয়ে ঘেরা। কোনোটি আবার কোনো সুনির্দিষ্ট সীমারেখা ছাড়াই।
পনের. লিপিগত প্রমাণের আলোকে এই এলাকায় ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ বসতির উল্লেখ করা হয়। লিপিগত প্রমাণে আছে ব্রাহ্মণদের বসতির জন্য আলাদা নিষ্কর জমি দান করা হচ্ছে। এগুলো ‘অগ্রহার’ বা ‘ব্রহ্মদেয়’ বসতি নামে সমধিক পরিচিত। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে আমরা এখনও এমন একটা বসতিও পাইনি যেটিকে কেবল ব্রাহ্মণ্য বা বৌদ্ধ হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। যে-বসতিগুলো আমরা চিহ্নিত করেছি সেগুলো বৌদ্ধ বিহার, বৌদ্ধ মন্দির ও হিন্দু মন্দির একই বসতিতে অবস্থিত। কালানুক্রমিকভাবে, আমরা এমন বসতি পেয়েছি যেখানে ১০ম -১১শ শতকের দিকে ব্রাহ্মণ্য ধর্মীয় প্রভাব বৃদ্ধির প্রচলিত ঐতিহাসিক ভাষ্যের সমর্থনে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায়। আবার, এমন বসতিও আমরা পেয়েছি যেখানে এর প্রমাণ পাওয়া যায় না। সমগ্র বরেন্দ্রের মত একটা বৃহৎ ভৌগলিক এলাকায় যেভাবে ব্রাহ্মণ্যধর্মীয় প্রভাববৃদ্ধির একটি সমসত্ত্ব ইতিহাস লেখা হয়, সেই লেখা তাই সমস্যাজনক। আদি মধ্যযুগীয় বরেন্দ্রে বা গৌড়ে স্থানভেদে বা কালভেদে এই প্রভাব বেড়েছে বা বাড়ে নাই।
ষোল. প্রচলিত ইতিহাসে যেভাবে আদি মধ্যযুগ ও মধ্যযুগকে একটি কালিক সীমারেখা দিয়ে পৃথক করা হয়, যেভাবে অনুমান করা হয় যে, বখতিয়ার খলজির এই এলাকা অধিকার করে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে এখানকার সমাজ ও অর্থনীতি পাল্টে গিয়েছিল মানব বসতির উপর্যোক্ত বৈশিষ্ট্যাবলি সেই ভেদরেখাকে অস্পষ্ট করে দেয়। রাজবংশের বদল বা শাসকদের ধর্মের বদলের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ ও সাধারণের জীবনযাপন পাল্টে যায় না।
ঘোড়াঘাটের বেলওয়া ও বোচাগঞ্জের বাসুদেবপুরে পরিচালিত প্রত্নতাত্ত্বিক খননের উপাত্ত এই লেখায় অন্তর্ভুক্ত করা হল না। ঘোড়াঘাট, পার্বতীপুর, কাহারোল, খানসামা, বোচাগঞ্জ ও বীরগঞ্জে পরিচালিত নিবিড় সামগ্রিক জরিপের/টোটাল সার্ভের ফলাফলও এই আলোচনায় বিবেচনা করা হল না। কারণ এখনো সেগুলোর মাধ্যমে প্রাপ্ত উপাত্ত বিশ্লেষণ সম্পন্ন হয় নাই।
তবে পরিসরের কথা বিবেচনা করে, যে আদি মধ্যযুগের প্রত্নতত্ত্বের ভিত্তিতে বরেন্দ্র বা গৌড়কে বোঝার যে ক্ষদ্র, সরল ও সংক্ষিপ্ত প্রয়াস আমি এখানে করলাম, বলাই বাহুল্য তা অসম্পূর্ণ ও নিরিখযোগ্য। সামনের দিনগুলোর গবেষণায় আমরা প্রচলিত ইতিহাসবোধের আরাম ও আত্মতুষ্টিকে নস্যাৎ করার মত আরো অনেক আলামত খুঁজে পাব সেটা নিশ্চিত। অতীতকে ভয় পেয়ে, আড়াল করে, অস্বীকার করে আর অবজ্ঞা করে কোনো লাভ নেই। অতীত কখনো না কখনো বর্তমানে নিজের বহুরূপী সত্তাকে প্রকাশিত করবেই। তাই অতীত সম্পর্কে প্রতিনিয়ত শিখে যাওয়াটাই এই মূহূর্তে প্রয়োজন।
তথ্যসুত্র ও টিকা:
১. দেখুন, নোটস, স্বাধীন সেন, দি ট্রানসফরমেটিভ কনটেকস্ট অফ এ টেম্পল ইন আরলি মেডাইভাল বরেন্দ্রী: রিপোর্ট অন দি এক্সক্যাভেশন এ্যাট তিলেশ্বরীর আড়া ইন দিনাজপুর ডিসট্রিক্ট, বাংলাদেশ। সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ, ৩১(১) (২০১৫).
২. দক্ষিণ এশিয়ায় ইতিহাসবিদ্যা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যুগবিভাজন বা কালপর্বীকরণ এই উপমহাদেশে সবসময়ই সমস্যাজনক। ইতিহাস বা সময়কে বিভিন্ন যুগে বা পর্বে বিভাজিত করে আলোচনা করতে গেলে একধরনের সমরূপীকরণ করতে হয়। কোনো নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য বা বৈশিষ্ট্যাবলিকে প্রধান ধরে নিয়ে এই কালপর্বীকরণ করতে হয়। জেমস মিল ভারতের ইতিহাসকে তিনটি যুগে/কালপর্বে – হিন্দু, মুসলমান ও বৃটিশ – বিভক্ত করেন। এই যুগবিভাজন ধর্মীয় পরিচয়কে প্রধান ধরে নিয়েছে প্রাক-ঔপনিবেশিক সময়ের ক্ষেত্রে। আবার, ঔপনিবেশিক সময়কে ‘বৃটিশ’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছে। যুগবিভাজনের এই পদ্ধতি পরবর্তীতে সমালোচিত হয়েছে, কারণ এই ইতিহাসে প্রাক-ঔপনিবেশিক সময়কালকে যুগ বিভাজন করে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যেন বৃটিশরা আসার আগে ভারত উপমহাদেশের কোনো ইতিহাস ছিল না। এই ঔপনিবেশিক ইতিহাসে অতীতকে নিকৃষ্ট ও পিছিয়ে পড়া হিসাবে পরিবেশন করা হয়েছে। পরবর্তীতে জাতীয়তাবাদী ইতিহাস রচনায় আগের যুগবিভাজনের সীমানা অক্ষুন্ন রেখে ‘প্রাচীন যুগ’, ‘মধ্যযুগ’ ও ‘আধুনিক যুগ’ হিসাবে যুগবিভাজন করা হয়। এই যুগবিভাজনও ঔপনিবেশিক ইতিহাসের মানদ-কে প্রশ্ন না করে, ওই মানদ- অনুসারেই নিজ নিজ সমৃদ্ধি ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের বয়ান হয়ে দাঁড়ায়। নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙালির ইতিহাস’ এই প্রবনতা থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করলেও, পুরোপুরি পারেন নাই। ভারতীয় জাতীয়তাবাদেও স্থানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রধান উপজীব্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু নীহার রায়ের প্রচেষ্টা রমেশ চন্দ্র মজুমদারের বাংলার ইতিহাসের তুলনায় অনেক বেশি জনমনস্ক। ‘ঐতিহাসিক’ যুগ আর প্রাগিতিহাসিক/প্রাগৈতিহাসিক যুগের পাশাপাশি ‘আদি ঐতিহাসিক’ ও ‘আদি মধ্যযুগ’ পদের ব্যবহারও আছে। অনেকে ( যেমন হারমান কুলকে বা দাউদ আলী) আদি মধ্যযুগ থেকে শুরু ঔপনিবেশিক সময়ের শুরু পর্যন্ত সময়কালকে মধ্যযুগ বলেন। একদল ঐতিহাসিক রাজবংশের নামে যুগবিভাজন করেন আর সেই যুগবিভাজনই আমাদের বিদ্যায়তনগুলোতে জনপ্রিয় টেকস্ট বইগুলোতে সবচাইতে প্রচলিত; যেমন: মৌর্য যুগ, কুশান যুগ, গুপ্ত যুগ, পাল যুগ, মোগল যুগ ইত্যাদি। এই ধরনের যুগবিভাজন খুবই বিপজ্জনক ও সমরূপকারী এবং উচ্চবর্গের ইতিহাসচৈতন্যের উপস্থাপনকারী। রাজবংশের/ শাসকদের বংশ পরিচয় দিয়ে যুগ/কালপর্ব চিহ্নিত করার অর্থ হচ্ছে একথা ধরে নেয়া যে, রাজবংশের বদলের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ, ধর্ম, অর্থনীতি আর বস্তুসংস্কৃতি পাল্টে যায়। সাম্প্রতিক কালের ইতিহাস লিখনে ঐতিহাসিকগণ তাই অনেক সতর্ক পর্যালোচনামূলক অবস্থান নিয়ে থাকে থাকেন ঐতিহাসিক কালানুক্রম ও যুগবিভাজন প্রসঙ্গে। যেমন, সম্প্রতি প্রকাশিত রণবীর চক্রবর্তী লিখিত ‘এক্সপ্লোরিং আরলি ইন্ডিয়া: আপ টু সার্কা. এডি ১৩০০’ (ম্যাকমিলান পাবলিসার্স, ২০১৩, সেকেন্ড এডিশন) বইয়ে এভাবে কালপর্বগুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছে : এক. ফ্রম দি বিগিনিং অফ হিউম্যান প্রেজেন্স টু দি ফার্স্ট সিভিলাইজেশন (আপ টু সি. ১৫০০ বিসি); দুই. ইন্ডিয়া ডিউরিং দি ডে অব দি ভেদিক করপাস (সি. ১৫০০ – ৬০০ বি.সি.); তিন. মহাজনপদাস, আরবান সেন্টারস এন্ড হেটেরোডক্স রিলিজিয়াস মুভমেন্টস (সি. ৬০০ – ৩০০ বিসি); চার. দি মৌর্য এমপায়ার (সি. ৩২৫ বিসি – ১৮৫ বিসি); পাঁচ. কনফ্রন্টেশনস, কমার্স এন্ড কালচারাল সিনারিও (সি. ২০০ বিসি – এডি ৩০০); ছয়. এ পলিটিকাল, সোস্যাল এন্ড কালচারাল ওভারভিউ: দি এপোক অফ দি গুপ্তাস এন্ড দেয়ার কনটেমপোরারিস (এডি ৩০০-৬০০); সাত. রিলম্স এন্ড রিজিওনস: প্রোফাইলস অফ ইকোনমি, সোসাইটি এন্ড কালচার (সি. এডি ৬০০-১৩০০)। বর্তমান ভারতের বিদ্যায়তনগুলোতে বিপুল প্রচলিত উপিন্দার সিং লিখিত বই ‘এ হিস্টোরি অফ এনশিয়েন্ট এন্ড আরলি মেডাইভাল ইন্ডিয়া: ফ্রম দি স্টোন এজ টু দি টুয়েলফথ সেন্টুরি’ (পিয়ারসন, ২০০৯) বইয়ে কালানুক্রম এমন: ইনট্রোডাকশন: আইডিয়াস অফ দি আরলি ইনডিয়ান পাস্ট; এক. আনডারস্টানডিং লিটেরারি এন্ড আর্কিওলজিকাল সোর্সেস; দুই. হান্টার গ্যাদারারস অফ দি প্যালিওলিথিক এন্ড মেসোলিথিক এজেস; তিন. দি ট্রানজিশন টু ফুড প্রোডাকশন: নিওলিথিক, নিওলিথিক-ক্যালকোলিথিক, এন্ড ক্যালকোলিথিক ভিলেজেস, সি. ৭০০০-২০০০ বিসিই; চার. দি হরপ্পান সিভিলাইজেশন, সি. ২৬০০-১৯০০ বিসিই; পাঁচ. কালচারাল ট্রানজিশনস: ইমেজেস ফ্রম টেক্সট এন্ড আর্কিওলজি, সি. ২০০০-৬০০ বিসিই; ছয়. সিটিস, কিংস এন্ড রিনানসিয়ান্টস: নর্থ ইন্ডিয়া, সি. ৬০০-৩০০ বিসিই; সাত. পাওয়ার এন্ড পিইটি: দি মৌর্য এমপায়ার, সি. ৩২৪-১৮৭ বিসিই; আট. ইন্টারএকশন এন্ড ইনোভেশন, সি. ৩০০-৬০০ সিই; নয়. এসথেটিকস এন্ড এমপায়ার, সি. ৩০০-৬০০ সিই; দশ. ইমারজিং রিজিওনাল কনভিগারেশনস, সি. ৬০০-১২০০ সিই।
৩. ‘মুসলমান’ নয়; কারণ, বিভিন্ন দলিলপত্র ও লিখিত সুত্র মারফত দেখা গেছে তৎকালীন সময়ে ‘মুসলমান’ নামক পদ কোনো বহিরাগত জনগোষ্ঠীর সত্তা বা পরিচয় প্রকাশের জন্য ব্যবহৃত হত না। মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তারা আসলেও সমসাময়িক সংস্কৃত লিখনিতে তাদেরকে তুর্কী হিসাবে, কখনো অপমানসূচক ম্লেচ্ছ বা যবন হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছি। তাদের নিজেদের লেখা বিবরণীতেও নিজেদের তারা মুসলমান হিসাবে চিহ্নিত করেন নাই। মধ্যযুগকে ‘মুসলমান’ বা ‘ইসলামি’ শাসনামল হিসাবে চিহ্নিত করাটা পরবর্তীকালের ঔপনিবেশিক ও হিন্দু জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকদের সৃষ্ট। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, ইতিহাসে হিন্দু যুগ বা বৌদ্ধ যুগ বলেও কোনো বর্গ নাই। ওই সময়ের শাসকদের হিন্দু হিসাবে চিহ্নিত করাও তাই কালবিভ্রান্তিকর। কোনো নির্দিষ্ট একটি অঞ্চলের নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বি মানুষের সত্তাকে ‘হিন্দু’ হিসাবে চিহ্নিত করাটা আদি মধ্যযুগ পরবর্তী ঘটনা। দেখুন, ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়, ইন্টারোগেটিং ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি: ভয়েসেস ফ্রম ইন্ডিয়াস এনসিয়েন্ট টেকস্ট। ইন্ডিয়ান হিস্টোরি কংগ্রেসের ২০১৪ অধিবেশনে পঠিত সভাপতির ভাষন। আরো দেখুন ডেভিড লোরেনজেন, ‘হু ইনভেন্টেড হিন্দুইজম: এসেস অন রিলিজিয়ন ইন হিস্টরি’, ( যোদা প্রেস, দিল্লি, ২০০৬)।
৪. সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা নিয়ে রামশরণ শর্মার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৯৫৮ সালে, ‘দি অরিজিন অব ফিউডালিজম ইন ইন্ডিয়া’ শিরোনামে জার্নাল অফ দি ইকোনোমিক এন্ড সোসাল হিস্টোরি অফ দি অরিয়েন্টে। এই বিষয়ে তার সর্বশেষ মতামত আছে ‘রিথিংকিং ইনডিয়ান পাস্ট’ বইয়ে যেটি প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালে। মাঝখানে প্রকাশিক অসংখ্য প্রকাশনার মধ্যে এখানে মাত্র দুইটির কথা উল্লেখ করছি: ‘ইন্ডিয়ান ফিউডালিজম’, (ম্যাকমিলান পাবলিসার্শ ইন্ডিয়া লিমিটেড, দিল্লি, থার্ড রিভাইজড এডিশন, ২০০৫) এবং ‘আরবান ডিকে ইন ইন্ডিয়া, সি. ৩০০- সি. ১০০০’(মুনশিরাম মনোহরলাল, দিল্লি, ১৯৮৭)। শর্মার তত্ত্বের প্রথম পর্যায়ের সমালোচনা করেন দিনেশ চন্দ্র সরকার [‘ল্যান্ডলর্ডিজম এন্ড টেন্যানসি ইন এনশিয়েন্ট এন্ড মেডাইভাল ইন্ডিয়া এজ রিভিলড বাই দি এপিগ্রাফিকাল রেকর্ডস’, (লাখনৌ, ১৯৬৯)]। পরবর্তী দীর্ঘমেয়াদী বিতর্কের জন্য দেখতে পারেন: হারমান কুলকে সম্পাদিত ‘দি স্টেট ইন ইন্ডিয়া, ১০০০-১৭০০’, (দিল্লি, ১৯৯৭); হরবনস মুখিয়া সম্পাদিত ‘দি ফিইডালিজম ডিবেট’, (নিউ দিল্লি, ১৯৯৯); ডি. এন. ঝা সম্পাদিত ‘দি ফিউডাল অরডার: স্টেট, সোসাইটি এন্ড আইডিওলজি ইন আরলি মেডাইভাল ইন্ডিয়া’, (নিউ দিল্লি, ২০০০)।
৫. বারটন স্টেইন, ‘পিজান্ট, স্টেট এন্ড সোসাইটি ইন মেডাইভাল সাউথ ইন্ডিয়া’ (অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮০)।
৬. ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়, পলিটিকাল প্রসেসেস এন্ড স্ট্রাকচার অফ পলিটি ইন আরলি মেডাইভাল ইন্ডিয়া। ১৯৮৮ সালের ইন্ডিয়ান হিস্টোরি কংগ্রেসেন প্রেসিডেন্টের ভাষন হিসাবে পঠিত। পরবর্তীতে তাঁর দি মেকিং অফ আরলি মেডাইভাল ইন্ডিয়া (অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০১২, দ্বিতীয় সংস্করণ) গ্রন্থে সঙ্কলিত। হারমান কুলকে, ‘ফ্রাগমেন্টেশন এন্ড সেগমেন্টেশন ভার্সাস ইনটিগ্রেশন? রিফ্লেকশন অন দি কনসেপ্ট অফ ইন্ডিয়ান ফিউডালিজম এন্ড দি সেগমেন্টারি স্টেট হস ইন্ডিয়ান হিস্টোরি’, স্টাডিজ ইন হিস্টোরি ৪(২), ১৯৮২।
৭. ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়, ‘ট্রেড এন্ড আরবান সেন্টারস ইন আরলি মেডাইভাল নর্থ ইন্ডিয়া’ আর ‘আরবান সেন্টারস ইন আরলি মেডাইভাল ইন্ডিয়া: এ্যান ওভারভিউ’ শিরোনামের প্রবন্ধ, যেগুলো একই লেখকের দি মেকিং অফ আরলি মেডাইভাল ইন্ডিয়া গ্রন্থে সঙ্কলিত হয়েছে।
৮. কুনাল চক্রবর্তী, ‘রিলিজিয়াস প্রসেস: দি পুরানাস এন্ড দি মেকিং অফ এ রিলিজিয়াস ট্রাডিশন’, (অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০১)।
৯. জেসন হকস, ফাইন্ডিং দি আরলি মেডাইভাল ইন সাউথ এশিয়ান আর্কিওলজি। এশিয়ান পারসপেকটিভ, ৫৩, ২০১৪।
১০. জুলিয়া শ, বুদ্ধিস্ট ল্যান্ডস্কেপ ইন সেন্ট্রাল ইন্ডিয়াধ সাঁচি হিল এন্ড আর্কিওলজিস অফ রিলিজিয়াস এন্ড সোসাল চেঞ্জ, সি. থার্ড সেঞ্চুরি বিনি টু ফিফত সেঞ্চুরি এডি, ( লেফট কোস্ট প্রেস, লন্ডন, ২০১৩)। জেসন হকস, ’দি ওয়াইডার আর্কিওলজিকাল কনটেক্সটস অফ দি বুদ্ধিষ্ট স্তূপা সাইট অফ ভারহুত’ আর আকিরা সিমাদা, ‘অমরাবতি এন্ড ধান্যকটক: টাইপোলজি অফ মনাসটিক স্পেসস ইন এনসিয়েন্ট ইনডিয়ান ইন্ডিয়ান সিটিস’। দুটো প্রবন্ধই জেসন হকস ও আকিরা সিমাদা সম্পাদিত ‘বুদ্ধিস্ট স্তূপাস ইন সাউথ এশিয়া: রিসেন্ট আর্কিওলজিকাল, আর্ট হিস্টোরিকাল এন্ড হিসটোরিকাল পারসপেকটিভস’, (অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, দিল্লি, ২০০৯) বইয়ে সঙ্কলিত। আরো দেখুন, স্বাধীন সেন, এ. কে. এম. সাইফুর রহমান ও সৈয়দ মোহাম্মদ কামরুল আহছান, ‘ক্রসিং দি বাউন্ডারিস অফ দি আর্কিওলজি অফ সোমপুর মহাবিহার: অলটারনেঠিভ এ্যাপ্রোচেস এন্ড প্রোপোজিশনস’, প্রত্নতত্ত্ব ২০, ২০১৪ , বিশেষ করে নোটস।
১১. ফ্রেডেরিখ এশার, নালন্দা: সিচুয়েটিং দি গ্রেট মনাসট্রি। মার্গ, ২০১৫।
…
১৩, ব্যাচেলরস কোয়ার্টার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; ১১ আগস্ট, ২০১৫
Leave a Reply